
ইরান–আমেরিকা ‘দ্বিতীয় যুদ্ধ’ যে চার কারণে আসন্ন
কয়েক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন এক পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা মধ্যপ্রাচ্যকে দ্বিতীয় দফা যুদ্ধের ঠেলে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিআইএ) প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেফ্রি ক্রুজকে ‘অসুবিধাজনক সত্য’ উচ্চারণের কারণে তিনি বরখাস্ত করেছেন।
অবাধ্যতা বা অযোগ্যতার মতো কোনো পাপ করেননি ক্রুজ। তাঁর গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন বোমা হামলায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি; বরং তা ছিল সামান্য। অথচ ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, হামলায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে ওই স্থাপনাগুলো।
জেনারেল ক্রুজের এ অপসারণ এবং ভাইস অ্যাডমিরাল ন্যান্সি লাকোর ও রিয়ার অ্যাডমিরাল মিলটন স্যান্ডসের বরখাস্তের ঘটনা শুধু জনবল বদল নয়, এটি প্রজ্ঞার চেয়ে আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল। আর এ ঘটনা অনিচ্ছাকৃতভাবেই হয়তো সে যুদ্ধে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে, যেটি ঠেকানোই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।
কয়েক সপ্তাহ আগে আমি একটি লেখায় বলেছিলাম, ইরানে দ্বিতীয় দফা মার্কিন হামলার আশঙ্কা রয়েছে। সে আশঙ্কা আরও দৃঢ় হচ্ছে। জেনারেল ক্রুজকে বাস্তব তথ্যভিত্তিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বরখাস্ত করা অত্যন্ত অশুভ সংকেত। যখন সত্য বানানো গল্পকে চ্যালেঞ্জ করে, তখন ট্রাম্প প্রশাসন বার্তাবাহককেই হত্যা করার পথ বেছে নেয়।
যে প্রতিবেদন ক্রুজের কর্মজীবনের অবসান ঘটাল, তাতে অভিযোগ করা হয়েছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দাবি মতো কয়েক বছরের জন্য নয়; বরং মাত্র কয়েক মাসের জন্য পিছিয়ে গেছে। আরও উদ্বেগজনক হলো ওই প্রতিবেদনে নিশ্চিত করা হয়েছে, হামলার আগেই ইরান গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক উপকরণ সরিয়ে নিতে পেরেছিল, আর ‘বৃহৎ বোমাবর্ষণ’ মূলত ওপরের দিকের অগভীর লক্ষ্যবস্তুতেই আঘাত হেনেছিল। গভীর ভূগর্ভস্থ বাংকার ও সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক অক্ষত থেকে গেছে।
এ গোয়েন্দা ব্যর্থতা ট্রাম্প প্রশাসনকে এমন এক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে, যেখানে জেতার কোনো পথ নেই। মিশন সমাপ্তির ঘোষণা দেওয়ার পরও সেটি শেষ না হওয়ায় এখন ট্রাম্পের সামনে কেবল দুটি বিকল্পই খোলা আছে। এক. পরাজয় স্বীকার করা অথবা আরও এক ধাপ এগিয়ে আবারও আক্রমণ করা।
ক্রুজের এ অপসারণ তেহরানের দৃষ্টিতেও এসেছে। খবরে এসেছে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, ইরান পশ্চিমাদের কূটনৈতিক প্রলুব্ধতার ফাঁদে পড়ে ‘প্রতারণার শিকার হবে না’। এ বক্তব্য ইরানের কৌশলগত চিন্তায় যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, তারই ইঙ্গিত দেয়। ইরান প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান থেকে আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষার দিকে যেতে পারে।
ইরানের যেসব সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে ইসরায়েল ১২ দিনের যুদ্ধের সূচনা করেছিল, তাঁদের উত্তরসূরি ইরানি কমান্ডাররা প্রকাশ্যে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, সেগুলো অভূতপূর্ব। পূর্বসূরিদের সংযমের বিপরীতে নতুন কমান্ডাররা বলছেন, নতুন কোনো যুদ্ধ শুরু হলে একেবারে প্রথম মিনিট থেকেই ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করবেন তাঁরা।
ইরান ঝুঁকি নিচ্ছে। আগের মতো প্রথমে আঘাত সহ্য করে পরে পাল্টা আঘাত করার পরিবর্তে তেহরান এবার টিকে থাকার জন্য আগাম হামলার কৌশল নিচ্ছে। ইরানের যুক্তি হলো, যদি যুদ্ধ অনিবার্য হয়, তবে আগাম আঘাত ইরানের টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।
ইসরায়েলি ও মার্কিন কৌশলবিদদের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে ইরানের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘আখির আল-জামান’। এটি এমন একটি ক্ষেপণাস্ত্র, যার অনেকগুলো ওয়ারহেড রয়েছে এবং এর গতি শব্দের গতির ১২ পর্যন্ত হতে পারে। এসব তথ্য সত্য হলে এটি ইরানের আক্রমণ সক্ষমতায় গুণগত পরিবর্তন আনবে। কেননা এটি এমন এক অস্ত্র, যা ইসরায়েলের আয়রন ডোম কিংবা প্যাট্রিয়টের মতো উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করে দিতে সক্ষম।
এ পরীক্ষার সময়টিও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাথমিক হামলার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটি সম্পন্ন হয়েছে, অর্থাৎ ইরান এখনো অচল হয়ে পড়েনি, তাদের সামরিক শিল্পের ভিত্তি চাপের মধ্যেও দ্রুত নতুন উদ্ভাবনে বাধাগ্রস্ত হয়নি।
ইরানের এই আরও আগ্রাসী ভূমিকা নেওয়ার আত্মবিশ্বাসের পেছনে দেশটির কৌশলগত অংশীদারদের ক্রমবর্ধমান সমর্থনও কাজ করছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যাচ্ছে, চীন ইরানের কাছে উন্নতমানের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিক্রি করছে, আর রাশিয়া সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সহায়তা দিচ্ছে।
এ সহযোগিতা সংঘাতের প্রক্সি মাত্রাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথমে এটি শুরু হয়েছিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে মার্কিন ও ইসরায়েলি অভিযানের মধ্য দিয়ে। সেটি এখন আরও বিস্তৃত দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী ভূরাজনৈতিক শক্তিগুলো জড়িয়ে পড়েছে। চীনের অংশগ্রহণ এ সংঘাতকে আঞ্চলিক মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যায় রূপান্তরিত করেছে এবং এটিকে বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার অংশে পরিণত করেছে।
ইরানের সঙ্গে ইসরায়েল-মার্কিন দ্বিতীয় দফার সংঘাত প্রচলিত ধারণার চেয়ে অনেক আগেই ঘটতে পারে। এর পেছনে কয়েকটি কারণ আছে।
গোয়েন্দা চাপ: ট্রাম্প এখন এমন গোয়েন্দা তথ্য পেতে পারেন, যা তাঁর পছন্দের বর্ণনাকে অস্বীকার না করে; বরং সেটা নিশ্চিত করে। ফলে বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়ার চক্র তৈরি হতে পারে।
ইরানের নীতি পরিবর্তন: তেহরান কৌশলগত ধৈর্য ত্যাগ করে আগাম আক্রমণের পথে যাওয়ায় সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ইরান যদি মনে করে, আক্রমণ অনিবার্য, তাহলে দেরি করার কোনো কৌশলগত উপকার নেই।
প্রযুক্তিগত সুযোগ: ইরানের নতুন ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা মার্কিন বা ইসরায়েলি সফল অভিযান করার সম্ভাব্য সময়সীমা কমিয়ে দিয়েছে। সামরিক পরিকল্পনাকারীরা যত বেশি অপেক্ষা করবে, ইরানের প্রতিরোধক্ষমতা তত শক্তিশালী হবে।
মিত্রশক্তির গতিশীলতা: চীন ও রাশিয়ার ইরানের প্রতি বাড়ানো সমর্থন মার্কিন হস্তক্ষেপকে উৎসাহিত করতে পারে।
আমি কয়েক সপ্তাহ আগে বলেছিলাম, আমরা যে পরিস্থিতি দেখছি, সেটা শান্তি নয়; বরং একটি বিরতি। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি চলছেই, ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি অগ্রসর হচ্ছে এবং আঞ্চলিক মিত্রশক্তিগুলোর সমর্থন আরও দৃঢ় হচ্ছে। অন্যদিকে মার্কিন ও ইসরায়েলি লক্ষ্য এখনো পূরণ হয়নি।
জসিম আল-আজাজি, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে সাংবাদিক ও লেখক
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত