ওয়াসা ভবন, ১ম তলা, ৯৮ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫, বাংলাদেশ
ফোনঃ 01767404822
Design & Developed by:
এ সম্পর্কিত আরও খবর
‘যাদের লক্ষ্য এক; কোনো পাহাড় বা সমুদ্র তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারে না’—কাজাখস্তানের আস্তানায় গত বছর সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনে দেওয়া বক্তৃতায় এ কথা বলেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ওই সময় ভাষণে সি চিন পিংয়ের কণ্ঠে চীনের এই প্রবাদ শোনা বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়েছিল। সে সময়ের বাস্তবতার সঙ্গে তাঁর বক্তব্যের কোনো মিল ছিল না। ২০২৪ সালে এসসিও সম্মেলন শুরুর আগে ভারতের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছিলেন, তিনি সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছেন না। জোটের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়েও এভাবে সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার ঘোষণা বেইজিং ও মস্কো নেতৃত্বাধীন এ জোটের প্রতি ভারতের প্রকাশ্য উপেক্ষার ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু এখন—এক বছর পর, বিশ্বের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে গেছে। এ বছর এসসিও সম্মেলনের আয়োজক চীন। দুদিনের এ সম্মেলন শুরু হয়েছে আজ রোববার। এবারের সম্মেলনে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নেতার উপস্থিতি আশা করা হচ্ছে। সম্মেলনে যোগ দিতে গতকাল শনিবার চীন পৌঁছেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি। ২০১৮ সালের পর এটা তাঁর প্রথম চীন সফর। আজ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও পৌঁছেছেন। দুই প্রতিবেশী দেশ চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ রয়েছে। তবে গত বছরের শেষদিক থেকে তাদের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা কমতে শুরু করেছে। ভারতীয় পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ নয়াদিল্লিকে বেইজিংয়ের আরও কাছাকাছি নিয়ে যেতে এবং সম্পর্ক আরও জোরদার করতে বাধ্য করেছে। ইউরেশিয়ার অন্য প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গেও ভারত সুসম্পর্ক গড়তে চাইছে। ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ করা ও নতুন শুল্ক আরোপের হুমকিতে বিশ্বজুড়ে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, অনেক দেশকে তা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, এমন পরিস্থিতিতে এসসিও সম্মেলন সি চিন পিংয়ের সামনে নিজেদের একটি স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে। এটি দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোকে একত্র করে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় সক্ষম করে তুলবে। বোহাই সাগরের তীরে চীনের বন্দরনগর তিয়ানজিনে এ বছর এসসিও সম্মেলনের আয়োজন হয়েছে। দুই দিনের এ সম্মেলন হবে আজ ৩১ আগস্ট ও আগামীকাল ১ সেপ্টেম্বর। বিভিন্ন দেশের ২০ জনের বেশি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং ১০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানের এ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। এই নেতাদের মধ্যে রয়েছেন এসসিও সদস্যদেশ—রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো, কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভ, উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিয়য়েভ, কিরগিজস্তানের প্রেসিডেন্ট সাদির জাপারভ ও তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমোমালি রাহমন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, মিয়ানমারের সামরিক প্রধান মিন অং হ্লাইং, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জুসহ আরও কয়েকজন নেতার এ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংস্থা আসিয়ানের মহাসচিব কাও কিম হর্নও সম্মেলনে অংশ নেবেন। এ বছর এমন এক সময়ে এসসিও সম্মেলন হচ্ছে যখন বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ শুরু হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে, গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা অব্যাহত আছে এবং দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে ভারতের বেঙ্গালুরুর তক্ষশীলা ইনস্টিটিউশনের ইন্দো-প্যাসিফিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের চেয়ারপারসন মনোজ কেওয়ালরামানি বলেন, বিশ্ব এখন স্পষ্টভাবে অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। সম্মেলনে তারা, বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া এ যুক্তি তুলে ধরবে যে বিশ্ব এখন বহু মেরুকরণ যুগে প্রবেশ করছে এবং অখণ্ড নিরাপত্তাকেই অগ্রগতির পথ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইবে। অনেকেই মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কারণে বহু দেশ মিলে তৈরি করা সমন্বিত উদ্যোগগুলো অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। মনোজ কেওয়ালরামানি বলেন, এ কারণেই এসসিও সম্মেলনটি গুরুত্বপূর্ণ। জোটের দেশগুলো এখনো একপক্ষীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে। এ জোট প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক-রাজনৈতিক বিষয়ে একমত হতে পারে না। যেমন রাশিয়া ইউক্রেনে তার যুদ্ধে প্রায় সব এসসিও সদস্যকে নিজের স্বার্থের সঙ্গে একমত করাতে সক্ষম হয়েছে। তবে ভারত সে পথে না হেঁটে ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করছে। নয়াদিল্লি ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি ও শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, পাশাপাশি রাশিয়া থেকে রেকর্ড পরিমাণ তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে। গত বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসসিওর সদস্যদের প্রতি এবারের সম্মেলনে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ ও পশ্চিম তীরে দখলদারি, লেবানন এবং ইরানসহ আরও কিছু বিষয়ে এসসিওর মধ্যে বিভেদ রয়েছে। এ বছর ইরানে ইসরায়েলের হামলার পর এসসিও ওই হামলার নিন্দা জানায়। কিন্তু ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানানোর ওই যৌথ বিবৃতিতে সমর্থন দেয়নি ভারত। ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একইভাবে ভারত ও পাকিস্তানকে নিয়ে এসসিও জোটের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। এমন মতবিরোধের কারণ হিসেবে মনোজ কেওয়ালরামানি বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন কারণ নিয়ে এ প্ল্যাটফর্মে উপস্থিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্য এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থেকে ও চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে আগ্রহী হয়ে যোগ দিয়েছে। ভারতের জন্য আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ দমন মূল কারণ।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিভিন্ন সময় দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর বিভিন্ন জোটের সমালোচনা করেছেন। অতীতে তিনি ব্রিকস জোটের সদস্যদের ওপর সুনির্দিষ্ট করে বিশেষ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে জোটটি ধ্বংস করার হুমকি দিয়েছেন। তিনি ব্রিকসকে ‘যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী’ বলেছিলেন। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও জনপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলেহান্দ্রো রেইজেস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবারের এসসিও সম্মেলন ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। এই পর্যবেক্ষণ বছরের শেষদিকে ভারতের আয়োজন করা কোয়াড সম্মেলনের ধারা নির্ধারণ করতেও সহায়ক হতে পারে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় ২০০৭ সালে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে কোয়াড বা কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ গঠন করে। চীনের উত্থান নিয়ে উদ্বেগ থেকে গত ২৫ বছরে ভারত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়ার তেল কেনায় ভারতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন ট্রাম্প। তিনি ভারতীয় পণ্যের পর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, কয়েক দিন আগে এটি কার্যকর হয়েছে। শুল্ক আরোপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র–ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভারতের চীন–ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগ্রহ এ বছরের এসসিও সম্মেলনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের গভীর নজর রাখার একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আগামীকাল তিয়ানজিনে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে মোদির বৈঠক হবে। রেইজেস বলেন, এসসিও সম্মেলনে ভারত ও চীনের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ কেমন হয়, সেটা যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে লক্ষ্য করবে। দিল্লি ও বেইজিং—দুই প্রতিবেশী পারস্পরিক উত্তেজনা নিরসনের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে শুল্ক নিয়ে টানাপোড়েন থাকলেও ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ভেঙে গেছে—এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক নয় বলে মনে করেন কেওয়ালরামানি। কেওয়ালরামানি বলেন, ‘প্রভাবশালী অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। যুক্তরাষ্ট্র তাই শুধু ভারতের ওপরই নজর রাখবে তেমনটা নয়; বরং পাকিস্তান, ইরান, এমনকি রাশিয়া ও চীনও কীভাবে এসসিও সম্মেলনে প্রধান ভূরাজনৈতিক ইস্যু ও বাণিজ্য নিয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম গড়ে তোলে সেটাও নজরে রাখবে।’