পাঞ্জশিরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান

পাঞ্জশিরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান

আন্তর্জাতিক
আফগানিস্তানের সশস্ত্র রাজনৈতিক দল তালেবানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা সর্বশেষ প্রদেশ পাঞ্জশির সম্পূর্ণ দখলের দাবি করেছেন দলটির মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ। সোমবার এক টুইট বার্তায় এই দাবি করেন তিনি। টুইট বার্তায় জবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ‘ভাড়াটে শত্রুদের শেষ ঘাঁটি পাঞ্জশির প্রদেশ সম্পূর্ণভাবে দখল করা হয়েছে।’

এদিকে প্রদেশের তালেবানবিরোধী বিদ্রোহীরা মুজাহিদের এই দাবিকে অস্বীকার করেছে।বিদ্রোহীদের সংগঠন ন্যাশনাল রেজিসটেন্স ফ্রন্ট অব আফগানিস্তানের (এনআরএফ) মুখপাত্র আলী মাইসাম ব্রিটেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে জানান, তালেবানের দাবি অসত্য।

তিনি বলেন, ‘এটি অসত্য। তালেবান পাঞ্জশির দখল করেনি। আমি তালেবানের দাবি প্রত্যাখ্যান করছি।’ তবে এই বিষয়ে এখনো এনআরএফ প্রধান আহমদ মাসুদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এর আগে পাঞ্জশিরের রাজধানী বাজারাকে তালেবান যোদ্ধাদের অগ্রসর হওয়ার ঘোষণার মধ্যেই রোববার রাতে এক ফেসবুক বার্তায় তিনি জানিয়েছিলেন, যুদ্ধ বন্ধে আফগান আলেমদের প্রস্তাবকে স্বাগতম জানাচ্ছেন তিনি। আলোচনার জন্য যুদ্ধ বন্ধে তিনি প্রস্তুত আছেন যদি তালেবান পাঞ্জশিরে হামলা ও সামরিক তৎপরতা বন্ধ করে।

দুই পক্ষের মধ্যে মতানৈক্যের জেরে আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর গত মাসের শেষে পাঞ্জশিরে অগ্রসর হয় তালেবান যোদ্ধারা। আফগানিস্তানের আলেমদের সংগঠন আফগান উলামা কাউন্সিল রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধ বন্ধ করে দুই পক্ষকে পুনরায় আলোচনায় বসার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলো।

১৫ আগস্ট তালেবান যোদ্ধাদের রাজধানী কাবুলে প্রবেশের পর আফগানিস্তানের ৩৪ প্রদেশের মধ্যে ৩৩টির ওপরই তালেবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধু কাবুলের উত্তরের দুর্গম পাঞ্জশির প্রদেশ তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়ে গিয়েছিলো। রুশ আগ্রাসন প্রতিরোধ যুদ্ধের কিংবদন্তি যোদ্ধা আহমদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমদ মাসুদের নেতৃত্বে তালেবানবিরোধী বিদ্রোহী যোদ্ধারা এই উপত্যকায় অবস্থান নিয়েছিলো।

১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতিরোধে পাহাড়ি পাঞ্জশির প্রদেশ বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। স্থানীয় তাজিক নেতা আহমদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বে প্রতিরোধ যোদ্ধারা রুশ আগ্রাসনকালীন পুরো ১০ বছরে এই প্রদেশে রুশ সৈন্যদের প্রবেশ করতে দেয়নি। রুশ দখলদারিত্বের প্রতিরোধ যুদ্ধে ‘শেরে পাঞ্জশির’ (পাঞ্জশিরের সিংহ) খ্যাতি পাওয়া আহমদ শাহ মাসুদের ভূমিকা তাকে আফগানদের মাঝে কিংবদন্তির স্থান দান করে।

রুশ আগ্রাসন পরবর্তী আফগান প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টির জেরে গৃহযুদ্ধের ফলে পাঞ্জশিরকে দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে পরিণত করেন আহমদ শাহ মাসুদ। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের প্রথম সরকারের আমলে এর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি তালেবান যোদ্ধারা।

২০০১ সালে এক সন্ত্রাসী হামলায় আহমদ শাহ মাসুদ নিহত হন।

অপরদিকে একই বছর যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার জেরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ হামলার জন্য আফগানিস্তানে আশ্রয়ে থাকা আলকায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করেন। ওই সময় আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের কাছে ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানান বুশ।

তালেবান সরকার ওসামা বিন লাদেনকে তুলে দেয়ার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার সাথে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে মার্কিনিদের কাছে প্রমাণ চায়। প্রমাণ ছাড়া তারা ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন প্রশাসনের কাছে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

বুশ প্রশাসন ও তালেবানের মধ্যে বিরোধের জেরে ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে আগ্রাসন শুরু করে মার্কিন বাহিনী। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রসজ্জ্বিত মার্কিন সৈন্যদের হামলায় তালেবান সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়।

তবে একটানা দুই দশক যুদ্ধ চলতে থাকে দেশটিতে।

এরইমধ্যে আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের সদস্য দেশগুলোও যুক্ত হয়। মার্কিনিদের সমর্থনে নতুন প্রশাসন ও সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠে দেশটিতে।

২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন সৈন্যদের এক ঝটিকা অভিযানে নিহত হন ওসামা বিন লাদেন। ২০১৩ সালে অজ্ঞাতবাসে তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের মৃত্যু হয়।

তা স্বত্ত্বেও তালেবান যোদ্ধারা আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে।

দীর্ঘ দুই দশক আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বের বহুজাতিক বাহিনীর দখলের পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাতারের দোহায় এক দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার করতে সম্মত হয় যুক্তরাষ্ট্র। এর বিপরীতে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অংশ নিতে তালেবান সম্মত হয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণা অনুসারে ৩১ আগস্ট আফগানিস্তান থেকে বহুজাতিক বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের ডেডলাইন থাকলেও ৩০ আগস্ট সম্পূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন হয়।

মার্কিনিদের সাথে চুক্তি অনুসারে ক্ষমতাসীন থাকা মার্কিন সমর্থনপুষ্ট আফগান সরকারের সমঝোতার জন্য তালেবান চেষ্টা করলেও দুই পক্ষের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। তালেবানের অভিযোগ, আশরাফ গনির নেতৃত্বাধীন আফগান সরকার দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি।

এর পরিপ্রেক্ষিতে মে মাসে বহুজাতিক বাহিনীর প্রত্যাহারের মধ্যেই পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালানো শুরু করে তালেবান।

৬ আগস্ট প্রথম প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলীয় নিমরোজ প্রদেশের রাজধানী যারানজ দখল করে তারা। যারানজ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ১০ দিনের মাথায় কেন্দ্রীয় রাজধানী কাবুলে পৌঁছে যায় তালেবান যোদ্ধারা। তালেবানের অগ্রসরে আশরাফ গনির কাবুল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার জেরে আফগান প্রশাসন ভেঙে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ আগস্ট কাবুলে প্রবেশ করে তালেবান যোদ্ধারা।

সূত্র : বিবিসি ও আলজাজিরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *