ক্রমশ গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার। সামরিক জান্তা শুধু গুলি করে মানুষ হত্যা করছে এমন নয়, তারা একই সঙ্গে আকাশ থেকে বোমা হামলা চালাচ্ছে থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে। এর ফলে ওইসব গ্রামের ভীতসন্ত্রস্ত লোকজন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছেন থাইল্যান্ডে। কিন্তু থাই কর্তৃপক্ষ তাদের আশ্রয় না দিয়ে পুশব্যাক করছে। উপায়হীন এসব মানুষ দেশে ফিরে বাংকার খুঁড়ে তাতে অবস্থান নিচ্ছেন।
জনতার পাশে থেকে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে তিনটি জাতিগত সংখ্যালঘু সশস্ত্র গ্রুপ। অন্যদিকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মধ্যবর্তী স্থানে কয়েক হাজার মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। তারা দেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু পুশব্যাক করেছে থাইল্যান্ড। এখন তাদের খাবার নেই। পানি নেই। ফলে চারদিকে এক গৃহযুদ্ধের পদধ্বনি। এরই মধ্যে সামরিক জান্তা হত্যা করেছে কমপক্ষে ৫১০ জনকে। লাশের মিছিল প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এ অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল। এ খবর দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার অনলাইন ডব্লিউএটুডে’তে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন ক্রিস ব্যারেট। এর শিরোনাম ‘‘দে হ্যাভ স্টার্টেড ডিগিং বাংকারস’: মিয়ানমার ডিসেন্ডস ক্লোজার টু সিভিল ওয়ার’’। অর্থাৎ জনগণ বাংকার খোঁড়া শুরু করেছে। মিয়ানমার ক্রমশ গৃহযুদ্ধের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। এতে ক্রিস ব্যারেট আরো লিখেছেন, থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী গ্রাম আই তু হতা। এখানে আকাশ থেকে বোমা ফেলা হচ্ছে। ফলে এ গ্রামের ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে চলে গিয়েছেন থাইল্যান্ডে।
কিন্তু থাই কর্তৃপক্ষ তাদেরকে পুশব্যাক করছে। ওইসব মানুষ এই অবস্থায় মিয়ানমারে ফিরতে চান না। না ফিরেও তাদের কোনো বিকল্প নেই। মিয়ানমারের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকার একটি বেসামরিক গ্রুপ কারেন পিস সাপোর্ট নেটওয়ার্কের (কেপিএসএন) পরিচালক নাও ওয়াহ খু শি দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড এবং দ্য এইজ’কে ওইসব মানুষ সম্পর্কে বলেছেন, এরা বোটে করে যখন সীমান্তের অন্যপাড়ে যাচ্ছেন, তখন তারা খবর পাচ্ছেন, যুদ্ধবিমান আবার গ্রামে আসছে। এতে এসব মানুষ আতঙ্কিত। ভয়ে চুপসে গেছেন। তিনি বলেন, আমরা জানি না, আবার হামলা হবে কিনা। উপায়হীন এসব মানুষের সামনে কোনো বিকল্প নেই। তাই তারা বাংকার খোঁড়া শুরু করেছেন।
ক্রিস ব্যারেট আরো লিখেছেন, গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা হত্যাসহ দমনপীড়ন নৃশংসতা অব্যাহত রাখার ফলে, গত দুই মাসে সেখানে কমপক্ষে ৫১০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এতে দেশটি এখন গৃহযুদ্ধের জড়িয়ে পড়ার হুমকিতে আছে। মিয়ানমারের জাতিগত তিনটি সশস্ত্র সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করে দেশের বিশাল অংশ। মঙ্গলবার তারা সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার হুমকি দিয়েছে। তারা বলেছে, যদি সামরিক জান্তা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে হামলা অব্যাহত রাখে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা গুলি করে, মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে, আর তাদের হাতে ডজন ডজন শিশু তাদের প্রাণ হারায় তাহলে জনতার পাশে থেকে তারা যুদ্ধ করবে।
এই তিনটি গ্রুপ হলো মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স আর্মি, আরাকান আর্মি এবং তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি। মিয়ানমারে চলমান প্রতিবাদ বিক্ষোভের অন্যতম প্রধান আয়োজক সংগঠন জেনারেল স্ট্রাইক কমিটি অব ন্যাশনালিটিজ এর আগে দেশের বহু জাতিগত মিলিশিয়া সংগঠনকে নতুন এই শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেয়ার আহ্বান জানায়। তার একদিন পরেই ওই তিনটি গ্রুপ এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে।
থাই সীমান্তের কাছে এখনও সংঘর্ষ অব্যাহত আছে। সেখানে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে সবচেয়ে সংগঠিত সংখ্যালঘু সশস্ত্র গ্রুপ কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন। সেনাবাহিনী সেখানে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার সপ্তাহান্তে বিমান হামলা করে। এতে কমপক্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। এই হামলার ফলে সীমান্তে সালউইন নদী এবং থাইল্যান্ডের মায়ে হোং সোন প্রদেশে আশ্রয় শিবিরের মধ্যবর্তী অবস্থানে ছিলেন দুই থেকে তিন হাজার মানুষ। তাদেরকে সোমবার রাতে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। থাই প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুত চান-ওচা সোমবার সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তারা শরণার্থীদের গ্রহণ করবেন। তার ভাষায়- তবে আমাদের ভূখণ্ডে দলে দলে (এক্সোডাস) নদীর স্রোতের মতো শরণার্থী চাই না। কিন্তু আমাদেরকে মানবাধিকারের দিকেও যত্ন নিতে হবে। কিন্তু তার দেশের স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা মিয়ানমারের এসব মানুষকে সীমান্ত অতিক্রম করতে দেবেন না।
থাইল্যান্ডে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিনিয়র গবেষক সুনাই ফাসুক থাইল্যান্ডের পুশব্যাক করার নীতিকে হৃদয়হীন এবং বেআইনি বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে অধিকার গ্রুপ থাই সামরিক বাহিনীর এহেন কর্মকাণ্ডকে হতাশাজনক বলে অভিহিত করেছে। খু শি বলেছেন, শরণার্থীরা যেদিন থাইল্যান্ডে পৌঁছেছেন তাদেরকে ফিরে যাওয়ার জন্য সেদিনই পরোক্ষভাবে চাপ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এসব মানুষের কোনো আশ্রয় নেই। এমন এক স্থানে তারা অবস্থান করছেন, যেখানে কোনো পানি নেই। আর আবহাওয়াও অত্যন্ত গরম। ফলে সেখানে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছে শিশুরা, অসুস্থ মানুষ ও বয়স্করা। শিশুরা খাবার ও পানি চাইছে। তারা কান্না করছে। খু শি বলেন, সাধারণত আমরা এমন অভাবী মানুষদের বিষয়ে সাড়া দিয়ে থাকি। কিন্তু এই মানুষদের কাছে আমরা পৌঁছাতে সক্ষম হচ্ছি না। থাইল্যান্ডের দিক থেকে কাউকে এসব মানুষের কাছে যেতে দিচ্ছে না সেনাবাহিনী।
১লা ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের পর এটাই মিয়ানমার থেকে দলবেঁধে মানুষের দেশ ছাড়ার প্রথম চেষ্টা নয়। পুলিশ সদস্য সহ কয়েক শত মানুষ পালিয়ে গিয়ে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু ওই সীমান্তও এখন সিল করে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে যেসব নাগরিক মিজোরামে গিয়েছেন তাদেরকে পুশব্যাক করার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। এ অবস্থায় মিয়ানমার সীমান্তে যে চাপ, উত্তেজনা তা-ই বলে দেয় দেশের ভিতরে কি মাত্রায় রক্তাক্ত দমনপীড়ন চলছে। এতে আঞ্চলিক এক মানবিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। নতুন স্পেশাল এডভাইজরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমারের সদস্য ক্রিস সিদোতি একসময় জাতিসংঘের তদন্তকারী ছিলেন। বর্তমানে তিনি বসবাস করেন সিডনিতে। তিনি বলেছেন, আমরা সুনির্দিষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি প্রথম দফায় গণহারে দেশ ছাড়ার লক্ষণ। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে যেসব মানুষ বসবাস করতেন তার মধ্যে বহু সংখ্যক মানুষ জাতিগত সংখ্যালঘুদের বসবাস এমন এলাকায় চলে গিয়েছেন। জাতিগত সংখ্যালঘুরা তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছেন। কিন্তু ওইসব এলাকায়ও সামরিক বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে মানুষ পালাচ্ছে।