তুরস্কে গত রবিবার অনুষ্ঠিত হয় শত বছরের সবচেয়ে গুরুত্ব নির্বাচন। এতে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী ছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান, কামাল কিলিচদারোগলু ও সিনান ওগান। তাদের মধ্যে কোনও প্রার্থীই এককভাবে ৫০ শতাংশ ভোট পাননি। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ৯৯ শতাংশ ভোট গণনা শেষে দেখা গেছে, এরদোয়ান পেয়েছেন ৪৯.৪ শতাংশ ভোট। তার প্রধান কামাল কিলিচদারোগলু পেয়েছেন ৪৩.১২ শতাংশ আর সিনান ওগান পেয়েছেন ৫.২ শতাংশ ভোট। ফলে আগামী ২৮ মে (রাউন্ড অফ) দ্বিতীয় দফা ভোট অনুষ্ঠিত হবে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে। সে হিসেবে পরবর্তী রাউডে ছিটকে পড়েছেন সিনান ওগান। প্রতিযোগিতা হবে এরদোয়ান আর কিলিচদারোগলুর মাঝে। এখন ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২৮ মে পর্যন্ত।
এদিকে, তুরস্কের এই নির্বাচন শুধু তুর্কি জনগণের জন্য নয়, বরং বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর আগেই অভিযোগ উঠেছে, তুরস্কে কিলিচদারোগলু নেতৃত্বাধীন রিরোধী শিবিরকে সমর্থন দিচ্ছে আমেরিকা। সুতরাং তুরস্কের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের জয় বা পরাজয় যুক্তরাষ্ট্র ও এর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মাথাব্যথারও কারণ।
কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার সময় বিশ্বের যে কয়েকজন রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান নিজ দেশের রাজনীতিতে ‘একনায়ক’ হিসেবে চিত্রিত করতে পেরেছেন, এরদোয়ান তাদের একজন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতে বড় এক ধাঁধাঁর নাম এরদোয়ান। কেননা, দু্ই দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা এরদোয়ান একাধারে ইউরোপের সবচেয়ে বড় মিত্র ও শত্রু, যুক্তরাষ্ট্রের পর ন্যাটোর সামরিক শক্তির সবচেয়ে বড় স্তম্ভ তুরস্ক তাদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের নেতৃত্বে বলকান, ভূমধ্যসাগর, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এক অনন্য নীতি নিয়ে এগিয়েছে, যা বাইডেন প্রশাসনের নীতিকে বারবারই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।অন্যদিকে, এরদোয়ান যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর অন্যতম নেতা হলেও তিনি এই জোটের মূল শত্রু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সখ্য বজায় রাখছেন। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্র নীতিতে চিহ্নিত সবচেয়ে বড় ‘সংকট’ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গেও রয়েছে এরদোয়ানোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
শুধু তা-ই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে চাপান-উতোর সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত ইরানের সঙ্গেও এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতি বদলানোর বিষয়েও চাপ দিয়ে যাচ্ছেন এরদোয়ান। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র হিসেবে পরিচিত কুর্দিদের উপর সামরিক অভিযান চালাচ্ছেন, আবার প্রতিবেশী আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সংকটেও মধ্যস্ততা করছেন, যেখানে মস্কোর প্রভাবও রয়েছে।এসব বিষয় বিবেচনা করলে প্রতীয়মান হয়, এরদোয়ান যেন যুক্তরাষ্ট্রের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘সিএনএন’ এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, জো বাইডেনের যুগ শুরুই হয়েছে দেশ ও দেশের বাইরে একনায়কতন্ত্র, গণতন্ত্রের উপর হামলা এবং উদীয়মান স্বৈরশাসকদের ছায়ায়।তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পরপরই ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটলে হামলা করে পরাজিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা, যা যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত।এই পটভূমিতে ক্ষমতা নেওয়ার পর এখন বাইডেন ইউক্রেইনের গণতন্ত্র রক্ষার যুদ্ধে নেমেছেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে তার ঘরের শত্রু ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার রিপাবলিকান সমর্থকেরা। যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে ইউক্রেনকে কোটি কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন, যা নিয়ে এরইমধ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন বেশ কিছু রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা, যারা ট্রাম্পের সমর্থক।
দেশের ভেতরের এমন পটভূমিতে বিদেশে বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতি বাস্তয়নে বাধা হয়ে উঠছেন এরদোয়ানের মতো কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রনেতারা। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র ইসরায়েলেও নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার সংবিধান বদলে সেদেশের গণতন্ত্রকে সঙ্কুচিত করার পথ ধরেছে।
গণতন্ত্র রক্ষার যে নীতি-অজুহাত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির মূল স্তম্ভ, তা টিকিয়ে রাখতে এরদোয়ানের মতো নেতার পরাজয় যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলেই মতামত তুলে ধরা হয়েছে সিএনএনের বিশ্লেষণে।এরদোয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দুই দশকের শাসনামলে তিনি তুরস্কের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন বিচারবিভাগ ও গণমাধ্যম এবং গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করেছেন।সিএনএন বলছে, আবারও নির্বাচিত হলে তিনি তুরস্কের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও সংকুচিত করার পাশাপাশি পশ্চিমের নেতৃত্বকে আরও সংকটের মুখেই ফেলবেন। যার অন্যতম উদাহরণ ন্যাটোতে সুইডেনের যোগদানে বাধা দেওয়া।এরআগে তুরস্কবিরোধী কুর্দি নেতাদের আশ্রয় দেওয়া নিয়ে ফিনল্যান্ডের বিষয়ে আপত্তি তুললেও পরে সমঝোতার মাধ্যমে এর সুরাহা হয়, কিন্তু সুইডেনকে ছাড় দেননি এরদোয়ান।তুরস্কের নির্বাচন নিয়ে রবিবার সাংবাদিকরা ডেলাওয়ারে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “আমি আশা করি, যিনিই জয়ী হোন, জয়ী হন। বিশ্বের ওই অংশে যথেষ্ট সমস্যা রয়ে গেছে।”
বিশ্বজুড়ে বাইডেনের গণতন্ত্র রক্ষার নীতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির ধ্রুপদী সংকটের আরেকটি উদাহরণ হিসেবেই চিহ্নিত হচ্ছে, সংকটটি হল- ‘কী করা উচিৎ যখন কোনও দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে কৌশলগত স্বার্থের সংঘাত হয়।’
স্বার্থ ও নীতির এই দ্বন্দ্ব সবচেয়ে স্পষ্ট হয়েছিল ২০১৮ সালে তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে সৌদি আরব দূতাবাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার ঘটনায়।
ওই ঘটনায় সরাসরি সৌদি আরবের জড়িত থাকার বিষয়ে প্রমাণ মিললেও যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিতে রাজি হয়নি। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দিলেও ক্ষমতা নেওয়ার পর জো বাইডেনও চুপ হয়ে যান; বরং রিয়াদ সফরে সালমানের সঙ্গে ‘ফিস্ট বাম্প’ করে নিজের সমর্থকের মুখে অনেকটাই কালি দেন তিনি।
ওয়াশিংটনের একই ধরনের ‘নীতি সংকট’ দেখা যাচ্ছে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও। গত কয়েক বছর ধরে সামরিক জান্তার শাসনাধীন থাইল্যান্ডেও রবিবার ভোট হয়েছে। ভোটে উদারপন্থি, গণতন্ত্রমনা দলগুলো জয়ী হতে যাচ্ছে বলে ধারণা পাওয়া গেছে, যারা সেদেশে আবারও পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছে।বাইডেনের প্রশাসনের নীতি অনুযায়ী এই দলগুলোর প্রতি ওয়াশিংটনের জোর সমর্থন জানানোর কথা থাকলেও হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে খুব একটা উচ্ছ্বাস দেখানো হচ্ছে না।থাইল্যান্ডে সামরিক জান্তার সমর্থনপুষ্ট ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী এই নির্বাচনে গণতন্ত্রপন্থিদের এই বিজয়কে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলে যুক্তরাষ্ট্রের উপর চাপ বাড়বে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার। কিন্তু ওয়াশিংটন হয়তো তা করতে চাইবে না, কারণ এই মুহূর্তে থাইল্যান্ডের জেনারেলদের ক্ষেপিয়ে দিতে বাইডেনের প্রশাসনের আগ্রহ কম। থাইল্যান্ড বিগড়ে গিয়ে যদি চীনের শিবিরে হেলে পড়ে, তাহলে বিশ্বের ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনীতিক স্বার্থ হুমকিতে পড়বে।প্রতিবেদনে সিএনএন উপসংহার টেনেছে, এ ধরনের যোগ-বিয়োগের রাজনীতিতে গণতন্ত্রকে সমর্থন জানান হয়তো সবসময় বাস্তবসম্মত হয় না, যা আমেরিকার ‘ডিএনএ’তেই রয়েছে। আর ভূরাজনীতির এই সমীকরণই বলে দিচ্ছে যে কেন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির পক্ষে এরদোয়ানের মতো আঞ্চলিক নেতাদের প্রভাব অস্বীকার করা অসম্ভব।