ডলারের বিপরীতে টাকার আরো দরপতন, বাড়ছে সংকট

ডলারের বিপরীতে টাকার আরো দরপতন, বাড়ছে সংকট

বাংলাদেশ
খোলাবাজারে ডলারের বিপরীতে টাকার আরো দরপতন হয়েছে। এক দিনের ব্যবধানে গতকাল বুধবার ডলারের দাম চার টাকা বেড়ে ১১৯ টাকায় উঠেছে, যা দেশের ইতিহাসে খোলাবাজারে সর্বোচ্চ। গত সোমবারও এই দাম ছিল ১১৫ টাকা ৬০ পয়সা। আর গত ২৬ জুলাই ডলারের দাম ছিল ১১২ টাকা।

এদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতেও ১০৮ থেকে ১১০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে ডলার। দামে রেকর্ড হওয়ার পরও ডলারসংকট দেখা গেছে। এর প্রভাব পড়ছে বিদেশগামী সাধারণ মানুষ, ভোক্তা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সবার ওপর।

অনৈতিক ব্যবসা : খোলাবাজারের ব্যবসায়ীদের দাবি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযানের ভয়ে ডলার বিক্রি বন্ধ রয়েছে। চাহিদার বিপরীতে বাজারে ডলার না থাকায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনৈতিক মুনাফা করে সংকট বাড়াচ্ছেন। অভিযানসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে তাদের কেউ কেউ ডলার কেনা বন্ধ রেখেছেন। তাদের অভিযোগ, অসাধু ব্যবসায়ীরা ডলার কেনা বন্ধ রেখেছেন। অথচ সুযোগ বুঝে কম দামে কিনে রাখা ডলার বিক্রি করছেন চড়া দামে। ডলার লাগলে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে বাইরে বাড়তি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। খোলাবাজারে সাধারণ গ্রাহক ডলার কিনতে গেলে তাদের পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট দেখিয়ে এখন ডলার দেওয়া হচ্ছে, যা আগে ছিল উন্মুক্ত। মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান এলাকার বেশির ভাগ মানি এক্সচেঞ্জে এখন ডলারের সংকট।

রপ্তানি আয়ের বিপরীতে আমদানি ব্যয় অনেক বাড়ায় কয়েক মাস ধরে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা চলছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রিসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। খোলাবাজারে ডলারের কারসাজি থামাতে রাজধানীর বিভিন্ন মানি চেঞ্জারে সম্প্রতি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের নিয়ে অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার কেনাবেচায় অনিয়মের অপরাধে গত সপ্তাহে রাজধানীর পাঁচ মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে ৯টি প্রতিষ্ঠান। আর কারণ দর্শানোর বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে ৪২টি প্রতিষ্ঠানকে। এর পরও অভিযুক্ত মানি এক্সচেঞ্জ, কিছু ব্যাংকের কারসাজি থামেনি। উল্টো অভিযানের অজুহাতে কেউ কেউ হাত গুটিয়ে বসে আছেন।

জানতে চাইলে গুলশান-২-এর এএসএন মানি এক্সচেঞ্জের পরিচালক সলিম উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশে মাত্র ২৩৫টি মানি চেঞ্জার বৈধ, আর ৬০০-র বেশি মানি চেঞ্জার অবৈধ, যাদের বিরুদ্ধে নিয়ম না মেনে লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। যারা বৈধ প্রতিষ্ঠান তারা পাসপোর্টের মাধ্যমে ডলার কেনে, পাসপোর্টের মাধ্যমে বিক্রি করে। পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট না থাকলে আমরা ডলার বিক্রি করছি না। ’

অতিমুনাফায় জড়িত ছয় ব্যাংক : ডলারের বাজার অস্থিতিশীল করে অতিরিক্ত মুনাফা করায় ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ট্রেজারি বিভাগ ব্যাংকের টাকা ও ডলারের জোগান ও চাহিদার বিষয়টি নিশ্চিত করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, কোনো কোনো ব্যাংক ডলার কেনাবেচা করে এক মাসে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করেছে। যার মাধ্যমে ডলারের বাজার আরো অস্থিতিশীল করে তোলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সামনে আরো ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডলার কেনাবেচায় অতিমুনাফার কারণে আমরা ছয়টি ব্যাংককে চিঠি দিয়েছি। আরো কারো বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ডলার বিক্রিও অব্যাহত রেখেছি। গতকালও আমরা ৯৫ টাকা করে ১১৪ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছি। খোলাবাজারেও আমাদের পরিদর্শন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। ’

টাকার অবমূল্যায়ন ১২.২ শতাংশ : ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত আছে। সর্বশেষ গত সোমবার ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৩০ পয়সা কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্ত ব্যাংকে প্রতি ডলার ৯৫ টাকা দরে বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক দর। এর ফলে গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার ১২.০২ শতাংশ অবমূল্যায়ন হলো। অন্যদিকে কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকে ১০৭ থেকে ১০৮ টাকা পর্যন্ত মূল্যে নগদ ডলার বিক্রি হচ্ছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের ভোগ্য পণ্য আমদানিকারক ও অসীম এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অসীম কুমার দাস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডলারের দাম যে হারে বাড়ছে তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। দুই-তিন মাস আগেও দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকার মধ্যে। ব্যাংকগুলো এলসি পেমেন্টে ১০৮ টাকার বেশি নিচ্ছে। ডলারের দাম হঠাৎ করে ২৫ শতাংশ বাড়ায় এর প্রভাব পড়ছে নানামুখী। এখন এলসি করে পণ্য আসতে আসতে রেট অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতে ভোক্তার ওপর চাপ বাড়ছে। সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি সংকটময়। ’

আমদানি কমলেও ডলারের সরবরাহ বাড়ছে না : আমদানি খরচ বাড়ায় গত মে মাস থেকে দেশে ডলারের সংকট চলছে। আমদানি নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগে জুলাইয়ে ব্যয় কমেছে ৩১ শতাংশ। একে স্বস্তিকর অবস্থা হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, জুলাই মাসে আমদানি হয়েছে ৫৪৭ কোটি ডলারের পণ্য, যা আগের মাসের চেয়ে প্রায় ৩ শতাংশের ১ শতাংশ কম। এর পরও ডলারের সরবরাহ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ছে না কেন—জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডলারের সরবরাহ কম হওয়ার ক্ষেত্রে মূল কারণ এলসির নিশ্চয়তাদানকারী বিদেশি ব্যাংকের এডি কনফারমেশনে আস্থা কমে যাওয়া। বাংলাদেশে নানা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হওয়ায় তারা ট্রেডলাইন ক্রেডিট (আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা) সুবিধা এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি যেখানে ডলারের প্রয়োজন, সেখানেই এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ’ করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারকে বিদেশি ব্যাংকের আস্থা বাড়াতে আলোচনায় বসতে হবে। টাকার আরো বড় অবমূল্যায়ন দরকার যাতে ব্যাংক ও খোলাবাজারের পার্থক্য কমে। তাহলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আরো বাড়বে। পাইপলাইনে থাকা উন্নয়ন সহায়তার অর্থ দ্রুত ছাড় করতে ইআরডিকে উদ্যোগ নিতে হবে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো সংস্থার কাছ থেকে বাজেট সহায়তা নিতে হবে। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আনতে আরো ছাড় দিতে হবে। অনাবাসি বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের জন্য পুঁজিবাজার, বন্ড মার্কেটের পাশাপাশি নিত্যনতুন সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। ’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম  বলেন, ‘ডলারের রেট বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক মুখে বলছে, কিন্তু বাস্তবে তা পুরোপুরি করছে না। ডলারের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। রপ্তানি বাজার সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এখন থেকেই নতুন বাজার সন্ধান করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *