চীনের টিকায় বিতর্ক তুঙ্গে ইন্দোনেশিয়ায়

চীনের টিকায় বিতর্ক তুঙ্গে ইন্দোনেশিয়ায়

আন্তর্জাতিক
সারা বিশ্ব করোনা নামক মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত। কাঁপছে পুরো বিশ্ব। করোনার ছোবলে রেহাই পায়নি কেউ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ভাইরাসটি তার নানা রকমের ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে এবং নতুন করে আরও শক্তিশালী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মানুষের মধ্যে। সম্প্রতি ভারতে শনাক্ত হয়েছে নতুন এক ধরন- ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এবং তা ছড়িয়ে পড়েছে  পৃথিবীর প্রায় সমস্ত অঞ্চলে। নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট প্রথমে  ভারতকে  বিপর্যস্ত করে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বে। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ায়  প্রতিদিন ২৫ হাজারের বেশি নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে তার মধ্যে অধিকাংশই এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আক্রোশে ইন্দোনেশিয়ায় এখন নাজেহাল অবস্থা। দুই ডোজ টিকা নিয়েও বেশ ক’জন স্বাস্থ্য কর্মীর মৃত্যুর পর সেদেশে দারুণ উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সেখানে স্বাস্থ্য-কর্মীদের বুস্টার ডোজ দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে জুন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ জন চিকিৎসক এবং ১০ জন নার্স কোভিডে ভুগে মারা গেছেন এবং ইন্দোনেশিয়ার ডাক্তার ও নার্স সমিতি বলেছে, মৃতদের সবারই চীনে তৈরি সিনোভ্যাক টিকা নেয়া ছিল। ইন্দোনেশিয়ায় এখন যেভাবে বিপজ্জনক মাত্রায় সংক্রমণ এবং মৃত্যু বাড়ছে তাতে অনেক বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিচ্ছেন দ্রুত যেন সমস্ত ডাক্তার, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্য-কর্মীদের একটি বুস্টার ডোজ অর্থাৎ সিনোভ্যাকের তৃতীয় একটি ডোজ দেয়া হয়।

ইন্দোনেশিয়ার ২৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে আট শতাংশেরও কম লোক টিকা পেয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি নানা ধরনের করোনাভাইরাস বিশেষ করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপে সংক্রমণের মাত্রা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। সেইসাথে সন্ত্রস্ত মানুষজন টিকা নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছেন।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানা যায় ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন শহরের টিকা কেন্দ্রগুলোতে শত শত মানুষের ভির।

ইন্দোনেশিয়াতে বর্তমানে প্রতিদিন ২০ হাজারেরও বেশি নতুন কোভিড রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এই হিসাবের চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি কারণ রাজধানী জাকার্তার বাইরে কোভিডের পরীক্ষার সুযোগ সীমিত। তবে ভ্যাকসিন পেলেও চীনের তৈরি সিনোভ্যাক আসলে কতটা সুরক্ষা দিতে পারছে বা পারবে তা নিয়ে ইন্দোনেশিয়াতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সেদেশে এখন পর্যন্ত একমাত্র সিনোভ্যাকের তৈরি ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত কোভিডে ভুগে ৯৪৯ জন স্বাস্থ্য কর্মী মারা গেছেন। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ জন ডাক্তার এবং ১০ জন নার্সের সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন নেয়া ছিল।

ডাক্তাররা এ নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে চাননা, কিন্তু তারা স্বীকার করেন তারা নিরাপদ বোধ করছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফুসফুস বিশেষজ্ঞ গণমাধ্যমকে জানান, সিনোভ্যাকের দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার এক মাস পর তিনি অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে দেখেন কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করার কোনো সুরক্ষাই দেহে তৈরি হয়নি।

‘কোন কাজই হয়নি। এই ভ্যাকসিন আমার শরীরে কোনো অ্যান্টিবডি (প্রতিরোধ শক্তি) তৈরি করেনি।’ আরো একমাস পর দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করেও তিনি একই ফল পান। তবে ঐ চিকিৎসক বলেন, তার কিছু সহকর্মী ভালো ফল পেয়েছেন, কিন্তু তার শরীরে সিনোভ্যাক টিকা কোনো কাজ করেনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি ব্যবহারের জন্য সিনোভ্যাক টিকা অনুমোদন করেছে। ডব্লিউএইচও সে সময় বলেছিল যে সিনোভ্যাক কোভিডের বিরুদ্ধে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা দেয় বলে পরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গেছে। আরো বলা হয়, পরীক্ষায় একশ ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে সিনোভ্যাক টিকা কোভিডের বিপজ্জনক উপসর্গ এবং হাসপাতালে ভর্তি ঠেকাতে কাজ করেছে।

চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেক কোম্পানি, যারা এই ভ্যাকসিন তৈরি করছে, দাবি করছে তাদের টিকার দুই ডোজ নিলে কোভিডের বিপজ্জনক উপসর্গ থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে। কোম্পানি বলছে, তৃতীয় ডোজ নেয়ার প্রতিক্রিয়া নিয়ে এখন ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালানো হচ্ছে এবং প্রাথমিক ফলাফল আশাব্যঞ্জক।

সিনোভ্যাকের প্রধান নির্বাহী ইন উইডং সম্প্রতি চীনা টিভি নেটওয়ার্ক সিটিভিকে বলেন, দুই ডোজ নেয়ার পর শরীরে প্রতিরোধী শক্তি তৈরি হচ্ছে । তৃতীয় ডোজ প্রয়োজন কিনা তা পরীক্ষার জন্য দয়া করে গবেষকদের আরো কিছুটা সময় দিন।  তৃতীয় ডোজ নিয়ে পরীক্ষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মি. ইন বলেন, দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার তিন থেকে ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ নেয়ার পর দেহে অ্যান্টিবডির শক্তির মাত্রা ১০ গুণ বেড়ে যেতে পারে, ১৫ দিনের মধ্যে সেই মাত্রা ৩০ গুণ বাড়তে পারে। ইন্দোনেশিয়ার মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ডব্লিউএইচও এবং সরকার যেসব ভ্যাকসিন অনুমোদন করেছে সেগুলো কোভিডের বিপদ কমাচ্ছে বলে তাদের আস্থা রয়েছে। তবে স্বাস্থ্য-কর্মীদের তৃতীয় ডোজ প্রয়োজন কিনা তা নিয়ে সমিতির ভেতর আলোচনা শুরু হয়েছে।

কোভিড ভ্যাকসিনের তৃতীয় ডেজ বা বুস্টার ডোজের পক্ষ যারা তাদের একজন অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির রোগতত্ত্ববিদ ড. ডিকি বুডিম্যান। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের একের পর এক ঢেউ আসছে। ফলে বুস্টার শট খুবই জরুরি। সিনোভ্যাকের সুরক্ষার মাত্রা বাড়ানো দরকার, বিশেষ করে এখন যেভাবে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মত নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের প্রকোপ চলছে। ইউনিভার্সিটি অব ইন্দোনেশিয়ার রোগতত্ত্ববিদ ড ত্রি ইউনিস মিকো বলেন, স্বাস্থ্য-কর্মীদের টিকা দেওয়া হয়েছে জানুয়ারিতে অর্থাৎ ছয় মাস আগে এবং তার মতে, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

তবে ইন্দোনেশিয়ার এয়ারলাঙ্গা ইউনিভারসিটির শিক্ষক ড উইধু পুর্নোমো তৃতীয় ডোজ টিকার বিরোধী। তিনি বলেন, এটা ঠিক যে আমরা দেখেছি পুরোপুরি টিকা নেয়ার পরও বেশ কজন স্বাস্থ্য কর্মী মারা গেছেন যেটা ঘটার কথা ছিল না। কিন্তু, তিনি বলেন, যদি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে সিনোভ্যাক অকার্যকর হয়, তাহলে তৃতীয় ডোজ টিকা দেওয়াও অর্থহীন। ইন্দোনেশিয়ার ভ্যাকসিন কর্মসূচি প্রকল্পের মুখপাত্র ড. সিতি সাদি তারমিযি বলেন, বুস্টার ডোজ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তের আগে তারা আরো তথ্যের জন্য অপেক্ষা করছেন। তৃতীয় ডোজ দেয়ার বিষয়ে এখনও কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র নেই। ডব্লিউএইচও কিছু বলছে না।। সুতরাং আমাদের উচিৎ অপেক্ষা করা। জানা যায়, দুই ডোজের পর সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন কতটা সুরক্ষা দিচ্ছে তা নিয়ে আমাদের বিজ্ঞানীরা একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছে। ঐ ট্রায়াল এখন তৃতীয় পর্যায়ে। ফলাফল পেলে তৃতীয় ডোজ দেয়ার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হবে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় কোভিড পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। এখন পর্যন্ত সেদেশে ২১ লাখ কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছে ৫৭,০০০। হাসপাতালে জায়গার সংকট এবং অক্সিজেনের সংকট দেখা দেয়ায় গত মাসেই ইন্দোনেশিয়ার রেড ক্রস দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলে, দেশ এখন কোভিড বিপর্যয়ের খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে।
মে মাস থেকে ইন্দোনেশিয়ায় শিশুদের মধ্যে সংক্রমণের হার তিনগুণ বেড়ে গেছে। এমনকি ছোট বাচ্চারাও কোভিডে মারা যাচ্ছে। সে কারণে প্রেসিডেন্ট উইডোডেো সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, ১২ বছরের বেশি বয়সী সবাইকে ভ্যাকসিন দেয়া হবে। সংক্রমণ সামলাতে জাভা এবং বালিতে দুই সপ্তাহের লক-ডাউন চলছে।

তবে জানা গেছে, ইন্দোনেশিয়ার এই সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশটিতে মডার্নার ৪০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় ইন্দোনেশিয়ায় যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন পাঠানো হচ্ছে। এই ভ্যাকসিন ইন্দোনেশিয়ায় করোনার বিরুদ্ধে জনগণকে সহায়তার জন্য পাঠানো হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। তবে ইন্দোনেশিয়ায় টিকার সিংহভাগ সরবরাহ এসেছে সিনোভ্যাক থেকে। ফলে, প্রশ্ন দেখা দিলেও সিনোভ্যাক দিয়ে টিকা কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া ছাড়া তেমন কোনো বিকল্প তাদের হাতে এখন নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *