গঙ্গার তীরে শত শত নতুন কবর : লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ভারতে!

গঙ্গার তীরে শত শত নতুন কবর : লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ভারতে!

আন্তর্জাতিক
দাহ করার জন্য শ্মশানে জায়গা হয়নি বলে মানুষজন মৃত স্বজনদের গঙ্গার তীরে এনে মাটি চাপ দিয়ে চলে গেছেন। কবর দেয়ার এসব ঘটনা ঘটেছে প্রধানত এপ্রিল মাসে। কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউতে বিপর্যস্ত ভারত। হাসপাতালে রোগীরা জায়গা পাননি। মৃতদের দাহ করার জায়গা মেলেনি শ্মশানে।

কোভিডের উপসর্গ নিয়ে মারা গেলেও মৃত্যুর আগে শত শত রোগীর কোনো চিকিৎসা তো দূরের কথা পরীক্ষা পর্যন্ত হয়নি। ঘরের ভেতরে বসেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। ফলে এসব মৃত্যু সরকারি তালিকাতেও জায়গা পায়নি। কিন্তু ভারতে বিশেষজ্ঞরা এখন নিশ্চিত গলায় বলছেন যে সরকার কোভিডে মৃত্যুর যে হিসেব দিচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ভারতে – বিশেষ করে দেশের গ্রামাঞ্চলে – মারা গেছে।

গ্রামের বাস্তব পরিস্থিতি কি, মৃত্যুর সংখ্যা চাপ দেয়ার অভিযোগ সত্যি কিনা – সরেজমিনে তা অনুসন্ধানের জন্য দিল্লিতে বিবিসির বিকাশ পাণ্ডে এবং অনশুল বর্মা গিয়েছিলেন উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কয়েকটি গ্রামে। বিসির সংবাদদাতারা তাদের অনুসন্ধানের জন্য প্রথম যে গ্রামটিতে যান তার নাম কৌশল্যা। দিল্লি থেকে ১০০ কিলোমিটারের মত দূরের এই গ্রাম থেকে প্রচুর মৃত্যুর খবর জানা গেছে।

সংবাদদাতারা গ্রামের অনেক সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলেন। সেই সাথে কথা বলেন গ্রাম পঞ্চায়েতের নেতাদের সাথেও। কৌশল্যা গ্রামের সমাজকর্মী মুস্তাফিজ খান কাগজে হাতে লেখা একটি লিস্ট দেখিয়ে বলেন, সরকার যা বলছে তাদের গ্রামে মৃত্যুর সংখ্যা তার কয়েকগুণ বেশি। গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য আবরার বললেন, কোভিডের উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর শিকার এসব মানুষের অধিকাংশরই কোনো পরীক্ষা হয়নি। ওষুধপত্র বা চিকিৎসাও তারা পাননি।

গ্রামের বাসিন্দা শফিক আহমেদ – যিনি পেশায় একজন আইনজীবী – জানালেন, ঐ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ হয় দিনমজুর না হয় কৃষক বা কৃষি-শ্রমিক। ফলে, তিনি বলেন, খুব কম লোকেই শহরে গিয়ে কোনো বেসরকারি ল্যাবে কোভিডের পরীক্ষা করিয়েছেন।

গ্রামের একটি সড়কে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কথা বলেন বিবিসির সংবাদদাতারা। জানতে পারেন, প্রতি দুটো বাড়ির অন্তত একটিতে এক বা একাধিক মানুষ কোভিডের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। গ্রামের ফারমান, সালমান এবং জাহিন তাদের মা এবং বড় ভাইকে হারিয়েছেন। বাড়ির দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শোকাহত তিন ভাই-বোন বিবিসির সাথে কথা বলেন।

“যেদিন আমার ভাই মারা গেলের, সেদিন গ্রামে নয়জন মারা গিয়েছিল, “ বলেন ফারমান। “কয়েক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলাম ভাইকে। সব জায়গাতেই বললো বেড নেই, অক্সিজেন নেই। তাদের করার কিছু নেই। ভাই শ্বাস নিতে পারছিলেন না। আতঙ্কে আমরা অক্সিজেনের জন্য নানা জায়গায় ছোটাছুটি করেছি।“ কিন্তু ভাই মেহমুদকে বাঁচাতে পারেননি তারা। একই পরিণতি হয়েছে তাদেরও মায়েরও।

সালমান বললেন, “ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম, কারণ বড় হাসপাতালে তো জায়গাই ছিলনা। ভেন্টিলেটর খালি ছিলনা। দরজা থেকেই তারা আমাদের পাঠিয়ে দিত।“ দুই ভাইয়ের কোলে ছিল বড় ভাইয়ের দুই বাচ্চা – একটি ছেলে, একটি মেয়ে। ফারমান বললেন “কে দেখবে এদের? সরকার কি কোনো দায়িত্ব নেবে।? আমাদের নিয়ে যে সরকারের কোনো মাথাব্যথাই নেই, তারা কি এই দুই শিশুর দায়িত্ব নেবে।?“

তাদের বোন জাহিন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “সরকারকে কিছু তো ভাবতে হবে। এই বাচ্চা দুটোর সামনে পুরো জীবন পড়ে রয়েছে।“ কৌশল্যার পরে কানৌজা নামে উত্তরপ্রদেশের আরেকটি গ্রামে গিয়েছিলেন বিবিসির সংবাদদাতারা। একই কাহিনী সেখানেও। বহু মানুষ কোভিডের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। কিন্তু তাদের পরীক্ষা হয়নি, চিকিৎসা হয়নি।

কানৌজা গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য উমেশ শর্মা একটি খাতা বের করলেন যাতে তার গ্রামের কোভিডে মৃতদের নাম লেখা রয়েছে। বললেন, “এদের মধ্যে এক বা বড় জোর দু’জনের নাম সরকারি হিসাবের মধ্যে গেছে, বাকি ৩০-৫৫ জনের কোনো হিসাব নেই।“ দুই গ্রামেরই লোকজন বললেন, এপ্রিল এবং মে মাসে কোভিড সংক্রমণ যখন চূড়ায় ছিল, গ্রামের সরকারি স্বাস্থ্য ক্লিনিক অচল ছিল।

প্রতিটি গ্রামে একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে একজন ডাক্তার থাকার কথা, নার্স থাকার কথা। কিন্তু কৌশল্যা গ্রামের প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় সেখানে নির্মাণ কাজ চলছে। কোনো ডাক্তার বা নার্স নেই। শুধু ক’জন শ্রমিক বসে রয়েছেন।

গ্রামবাসীরা বলছেন, সরকারি এই চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে শুধু যদি কিছু অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকতো তাহলেও অনেকগুলো প্রাণ হয়তো বাঁচতো।

উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ শহরের কাছে গঙ্গার তীরে শত শত নতুন কবরের সারি। দাহ করার জন্য শ্মশানে জায়গা হয়নি বলে মানুষজন মৃত স্বজনদের এখানে এনে মাটি চাপ দিয়ে চলে গেছেন। কবর দেয়ার এসব ঘটনা ঘটেছে প্রধানত এপ্রিল মাসে।

এলাহাবাদে কবর প্রসঙ্গে কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে মৃতদেহ না পুড়িয়ে নদীর পাশে কবর দেয়ার চল রয়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।তবে স্থানীয় অনেক মানুষ এবং সাংবাদিকরা বিবিসিকে বলেন, এবছর এই কবর দেয়ার সংখ্যা অস্বাভাবিক মাত্রায় বেশি।

“এই একটি জায়গাতেই এ বছর ২৪০০ থেকে ৩০০০ লোককে কবর দেয়া হয়েছে, “ বিবিসিকে বলেন স্থানীয় শ্রীংভেরপুর শ্মশানের পুরোহিত লবকুশ মিশ্র। এলাহাবাদের কাছে মেনডারা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান বিবিসিকে জানান, তার গ্রামে ডজন ডজন মানুষ কোভিডের লক্ষণ নিয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে।

মহেশ্বর কুমার সোনি বলেন, মৃত এসব রোগীর কখনো কোভিডের পরীক্ষাও হয়নি। “আমাদের গ্রামে এই হারে মৃত্যু আমরা জীবনেও দেখিনি। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।“ মেনডারা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান বলেন, সরকারের উচিৎ তদন্ত করে কোভিডে মৃতদের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করা। গ্রামের মানুষজন বলছেন, বহু মানুষ যে কোভিডের পরীক্ষা বা চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন সরকারের উচিৎ তা অন্তত স্বীকার করা। তাতে অন্তত সেসব মৃত মানুষদের কিছুটা মর্যাদা দেয়া হবে। বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *