বিদ্যমান এমপিও নীতিমালার ব্যাপারে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের নানা আপত্তি রয়েছে। ডিগ্রি স্তরের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষকরা এমপিও পাচ্ছেন না। সহকারী অধ্যাপক হিসেবেই কেটে যায় কলেজ শিক্ষকদের চাকরিজীবন। অনার্স-মাস্টার্স কলেজের শত শত শিক্ষক সরকারি ভাতা (এমপিও) পান না। এমফিল-পিএইচডির মতো উচ্চতর ডিগ্রির জন্য নেই আলাদা কোনো প্রণোদনা। নিয়োগে শর্ত আরোপের কারণে শত শত কলেজে উপাধ্যক্ষের পদ শূন্য। এ ধরনের বিভিন্ন অভাব-অভিযোগের পরও মৌলিক পরিবর্তন ছাড়াই প্রস্তাবিত ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা’র খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির (বাকশিস) সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হক বলেন, ‘বিদ্যমান এমপিও নীতিমালার বিভিন্ন দিক নিয়ে শিক্ষকদের নানা আপত্তি আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্য, নিপীড়ন আর বঞ্চনা তৈরির পথও আছে। আবার এমন বিধানও যুক্ত আছে যার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সমস্যা হচ্ছে। যেমন, ১২ বছরের এমপিও-ইতিহাস আর এরমধ্যে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ৩ বছরের অভিজ্ঞতার বিধান আছে। এতে প্রার্থীর অভাবে শত শত কলেজে উপাধ্যক্ষ নিয়োগ করা যাচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘একবার একটা নীতিমালা হয়ে গেলে সেটি সংশোধনে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। তাই যেসব বিষয়ে শিক্ষকদের সমস্যা আছে সেগুলো সমাধান করেই নীতিমালা চূড়ান্ত করা প্রয়োজন। এমন কোনো নীতিমালা তৈরি করা ঠিক হবে না যেটা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হবে। আমরা বাকশিস থেকে ১১টি দাবি লিখিতভাবে দিয়েছি। সেখানে সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।’
এদিকে এমপিও নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সর্বশেষ গত মাসের শেষ সপ্তাহে প্রস্তাবিত নীতিমালা নিয়ে বৈঠক হয়। প্রস্তাবিত নীতিমালায় বেশকিছু ইতিবাচক দিক যুক্ত আছে। এরমধ্যে অন্যতম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির শর্তে পরিবর্তন। বিদ্যমান নীতিমালায় চারটি শর্ত পূরণ করতে হয়।
এগুলো হল- প্রতিষ্ঠানের বয়স বা স্বীকৃতির মেয়াদ, পাবলিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা, প্রতিষ্ঠানের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং পাসের হার। শুধু স্কুল ও কলেজের ক্ষেত্রে প্রথম শর্তটি প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ, পরের তিনটির ওপর নম্বর দেয়া হবে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে। তবে মাদ্রাসা আর কারিগরি প্রতিষ্ঠানকে চারটি শর্তের ওপরই নম্বর দেয়া হবে।
উল্লিখিত শর্তে কিছু শিথিলতার প্রস্তাবও করা হয়েছে। বিদ্যমান নীতিমালায় গ্রাম ও শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাসের হার একই চাওয়া হতো। প্রস্তাবিত নীতিমালায় গ্রাম ও শহরের জন্য ভিন্ন পাসের হার নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থী সংখ্যায় কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। বিদ্যমান নীতিমালায় শহরে ৬০ জন আর গ্রামে ৪০ জন নির্ধারিত আছে। প্রস্তাবে কলেজের ক্ষেত্রে বিভাগভিত্তিক (বিজ্ঞান, মানবিক ও বিজনেস স্টাডিজ) আলাদা শিক্ষার্থীর শর্ত আরোপ করায় এখন শহরের প্রতিষ্ঠানে ১৩৫ জন আর গ্রামে ১০৫ জন করা হয়েছে। পাশাপাশি স্কুল এবং ডিগ্রি কলেজেও এ ক্ষেত্রে কঠোরতার প্রস্তাব আছে। তবে মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানে পাসের হারে শিথিলতা আনা হয়েছে।
ডিগ্রি স্তরে নিয়োগ করা হয় বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক। কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক থাকলে প্রতি বিষয়ে ৩ জন শিক্ষক নিয়োগের বিধান করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সরকার এমপিও দেয় দু’জনকে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে তৃতীয় শিক্ষকের বিষয়টি উত্থাপিত হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধির কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। কিন্তু তার ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা। ফলে বৈঠকে এটি অনুমোদন পায়নি। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলাপ শেষে বিষয়টি নিষ্পত্তির আশ্বাস দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। অন্যদিকে অনার্স-মাস্টার্স কলেজের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির দীর্ঘ দাবিটিও প্রস্তাবিত নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক সমিতির সভাপতি নেকবর হোসাইন জানান, সারা দেশে এ ধরনের ৩৪৯টি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষক আছেন। অথচ তারা বেতন পাচ্ছেন না। বেতনবিহীন চাকরিতে পাঠদান আর লেখাপড়া কতটুকু আন্তরিকভাবে হতে পারে সেটা নীতি-নির্ধারকদের ভেবে দেখা উচিত।
বর্তমানে কলেজ শিক্ষকরা পদোন্নতি পান অনুপাতের ভিত্তিতে। এ প্রথাকে শিক্ষকরা নিবর্তনমূলক হিসেবে আখ্যায়িত করে বাতিলের দাবি করে আসছেন। কিন্তু প্রস্তাবিত নীতিমালায়ও এখন পর্যন্ত কোনো দিক-নির্দেশনা যুক্ত করা হয়নি। বিদ্যমান বিধানে কোনো কলেজে ৭ জন প্রভাষক থাকলে ২ জন সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন। এটি ৫০ শতাংশ বা ২ জন প্রভাষকের একজনকে সহকারী অধ্যাপকের পদোন্নতির প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু এটিও চূড়ান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। তবে উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি কলেজ শিক্ষকদের আলাদাভাবে চেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে প্রভাষকদের পরের পদ ‘সিনিয়র প্রভাষক’ আর ডিগ্রি কলেজে আগের মতোই ‘সহকারী অধ্যাপক’ রাখার প্রস্তাব এসেছে। অপরদিকে স্কুলে সহকারী শিক্ষকের পর নতুন একটি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে সিনিয়র সহকারী শিক্ষক। এরপর সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ থাকবে। এ পরিবর্তনজনিত স্কেল তৈরি করা হবে। এক্ষেত্রে সিনিয়র সহকারী শিক্ষকদের ৯ম গ্রেড দেয়ার চিন্তা চলছে। এছাড়া এ পদোন্নতিতে শুধু বয়স নয় বিএড ডিগ্রি, এসিআরসহ আরও কিছু দিক যুক্ত করা হচ্ছে। ১০০ নম্বরে মূল্যায়ন করা হবে। তবে শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি- ডিগ্রি-অনার্স-মাস্টার্স কলেজে সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপকের পদ সৃষ্টির। কিন্তু প্রস্তাবিত নীতিমালায়ও সেই প্রতিফলন নেই।
এমপিও নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার বলেন, বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের যে দাবি ছিল তার ধারে-কাছেও যায়নি মন্ত্রণালয়। বৈঠকে বারবার বলেও শোনাতে পারিনি। আমাদের দাবি ছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নতুন করে স্থাপন নিষিদ্ধ করে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা করা হোক। কোথাও প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন হলে সেটা সরকার করতে পারে, বেসরকারিভাবে আর নয়। তার মতে, কলেজের শিক্ষার্থীর নতুন সংখ্যা নির্ধারণ করায় এখন আর কোনো প্রতিষ্ঠান এমপিও পাবে না। নন-এমপিও সাড়ে ৫শ’ কলেজের মধ্যে ২০১৯ সালে ৮২টিকে পাওয়া গেছে। নতুন শর্তের কারণে এখন একটিও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। আসলে মন্ত্রণালয় এমপিও দিতে চায় কিনা- সেটা নিয়েই সংশয় আছে।
এদিকে কয়েকশ’ কলেজে উপাধ্যক্ষের পদ শূন্য আছে। বিশেষ করে ঢাকার বড় প্রায় সব কলেজেই উপাধ্যক্ষের পদ শূন্য। এ পদে আবেদনকারীকে ১২ বছরের এমপিওধারী এবং ৩ বছরের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত থাকার শর্ত আরোপ করা আছে বিদ্যমান নীতিমালায়। ফলে যোগ্য প্রার্থীর ভয়াবহ সংকট চলছে। প্রস্তাবে মূল্যায়ন করা হয়নি এমফিল-পিএইচডির মতো উচ্চতর ডিগ্রি। অথচ তৃতীয় শ্রেণি প্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়োগে নিষেধাজ্ঞার শর্তে শিথিলতার চিন্তা চলছে।
এমপিও নীতিমালা সংশোধন কমিটির আহ্বায়ক মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) মোমিনুর রশীদ আমিন বলেন, সরকার শুধু প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিদ্যমান নীতিমালার সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন করছে। নতুন কিছু অন্তর্ভুক্ত করছে না। পুরনো কিছু বিষয়ে হালনাগাদ প্রস্তাব আছে। আর নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্তিতে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত দরকার।
মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য: জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, শিক্ষার উন্নয়ন বিবেচনায় রেখে প্রস্তাবিত নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। প্রয়োজনের নিরিখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন পদসহ অন্যসব প্রস্তাব করা হয়েছে। নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত। এখন নীতিমালার ওপর মতামত নিতে শিগগির তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।