ভরা মৌসুমে অস্থির চালের বাজার

বাংলাদেশ

এমনিতেই নানা ছুঁতোয় দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নেয় বাজার সিন্ডিকেট। করোনা মহামারিকালে তারা যেন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এক পণ্য নিয়ে কারসাজি শেষ হতে না হতেই আরেক পণ্য টার্গেট করছে এই চক্র। করোনার কারণে যখন বিভিন্ন খাতে চাকরি হারিয়েছেন লাখ লাখ কর্মী, রোজগার কমে গেছে বেশির ভাগ শ্রমিকের; সেই সময়ই সিন্ডিকেটের থাবায় বেড়ে গেল সবচেয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য চালের দাম। এতে আরো বিপাকে পড়েছেন করোনায় নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষ।

এদিকে মাসখানেক আগেই আমন ধান উঠেছে কৃষকের ঘরে। এই ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়াতে বিব্রত খাদ্য মন্ত্রণালয়। চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করতে চিঠি দিয়েছে তারা। এছাড়া অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযান চালাবে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর। আগামীতে কোনো মিলার যাতে কারসাজি করতে না পারে, সে জন্য অটোরাইস মিলের অনুমোদন আপাতত বন্ধ রাখতে সুপারিশ করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ঘাটতি মেটাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ১ লাখ টন চাল আমদানিরও অনুমতি চাওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ভারত থেকে ৫০ হাজার টন নন-বাসমতি চাল আমদানির অনুমোদনও দিয়েছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এছাড়া আগামী সোমবারের বৈঠকে এসব বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হবে বলে জানিয়েছে সূত্র।

রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২-৬৬ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫৮-৬২ টাকা। এর আগের সপ্তাহে অর্থাৎ দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৫৪-৬০ টাকা। আর প্রতি কেজি মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৪-৫৮ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫০-৫২ টাকা। গরিবের চাল খ্যাত মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪৬-৫০ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ৪২-৪৬ টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে মিনিকেট ও নাজিরশাইল বা সরু চালের দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা চালের দাম বেড়েছে দশমিক ৯৭ শতাংশ। আর মোটা বা স্বর্ণা ও চায়না ইরি চালের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ১০ শতাংশ।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী একাধিক চালের আড়তদার ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা কুষ্টিয়ার রশিদের মিনিকেট ২৫ কেজির বস্তা আগে বিক্রি করতাম ১৪০০ টাকা। এখন সেই চাল বিক্রি করছি ১৬০০ টাকায়। অর্থাৎ কেজিতে বেড়েছে ৮ টাকা। দুই সপ্তাহের মধ্যে দুই ধাপে এই দাম বেড়েছে। আর রশিদের চালের দাম বাড়ার কারণে অন্যরাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ৬২ টাকা কেজির নিচে এখন কোনো খোলা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে না।

শুধু রাজধানীতেই নয়, চালের দাম বেড়েছে সারাদেশেই। এমনকি খাদ্যভাণ্ডার খ্যাত কুষ্টিয়া এবং নওগাঁয়ও চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। আমাদের চট্টগ্রাম অফিস জানায়, দুই দিনের ব্যবধানে চাক্তাই ও পাহাড়তলীর পাইকারি বাজারে সব ধরনের চালের দাম বস্তা প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দফায় দফায় চালের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন ক্রেতারা। দরের ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে উত্তরবঙ্গের মিল মালিকদের সিন্ডিকেটকে দুষছেন পাইকাররা। চট্টগ্রামের চালের পাইকারি বাজার পাহাড়তলী চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নেজাম উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, রাইস মিলগুলো উত্তরবঙ্গে। মিলারদের কারসাজির কারণে চালের দাম বেড়েছে। মিল মালিকদের কাছে চালের মজুত থাকলেও তারা বলছে, তাদের কাছে চাল নাই। কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে তারা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। উত্তরবঙ্গের মিল মালিকদের নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। যাতে তারা সংকট দেখিয়ে চালের দাম বৃদ্ধি করতে না পারে। এছাড়া চাল আমদানি উন্মুক্ত করতে হবে। সাধারণ ব্যবসায়ীরা যাতে সহজে চাল আমদানি করতে পারে, তার অনুমতি দিতে হবে।

রাজশাহী প্রতিনিধি জানান, বাজারে চালের দাম কেজিতে ৩-৪ টাকা বেড়েছে। স্থানীয় পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, রাজশাহী অঞ্চলে চালের বাজার অদৃশ্য এক সিন্ডিকেটে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এ সিন্ডিকেটে অটোরাইস মিল মালিক ও শতাধিক ব্যবসায়ী রয়েছেন। ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যার ধোয়া তুলে চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে তারা।

রংপুর প্রতিনিধি জানান, রংপুরের বাজারে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের চালের দাম ৪-৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ৫০ কেজির প্রতি বস্তায় বেড়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। হুট করে চালের এই দাম বৃদ্ধির জন্য মিল মালিকদের দায়ী করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, উত্তরাঞ্চলে খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত নওগাঁয় এক সপ্তাহের ব্যবধানে চিকন ও মোটা চালের দাম প্রতি কেজিতে ৪-৫ টাকা বেড়েছে। আর বস্তাপ্রতি বেড়েছে ১০০-২০০ টাকা। বাজারে মোটা থেকে চিকন চাল কেজিপ্রতি বেড়েছে ৪-৫ টাকা। অথচ বিভিন্ন মিলে গিয়ে তথ্যানুসন্ধান করে দেখা গেছে, মিলে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল মজুত আছে।

দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, দিনাজপুরে নতুন ধান বাজারে এলেও জেলায় অস্থির চালের বাজার। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দিনাজপুরে ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ১৫০-২০০ টাকা। আর কেজিপ্রতি বেড়েছে ৩-৪ টাকা। বাজারে চাল বিক্রেতারা বলছেন, নতুন ধান বাজারে এলেও মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দেয়ায় বাজারে চালের দাম বেড়েছে।

এদিকে চালের প্রধান মোকাম কুষ্টিয়ার মিল মালিকরা বলছেন, ধানের দাম বাড়ার কারণে মাসখানেক আগে চিকন চালসহ অন্যান্য চালের বাজার কেজিতে এক থেকে দুই টাকা বেড়েছিল। ধানের দাম বাড়ায় নতুন করে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। মিনিকেট চাল কেজিতে ৪ টাকা ও মোটা সব ধরনের চাল কেজিতে ৩ টাকা পর্যন্ত মিলগেটে দাম বেড়েছে। ধানের দাম বাড়ায় চালের বাজার সমন্বয় করতেই এ দাম বাড়ানো হয় বলে জানান তারা।

কুষ্টিয়ার লিয়াকত রাইস মিলের মালিক হাজি লিয়াকত হোসেন বলেন, ধানের দাম প্রতি মণে ১০০ টাকা বেড়েছে। সেই কারণে চালের দাম মিলগেটে বেড়েছে। চিকন জাতের মিনিকেট চাল ২৫ কেজির প্রতি বস্তা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪২০ টাকা থেকে ১ হাজার ৪৩০ টাকা। সেই হিসেবে ৫০ কেজির বস্তার দাম হচ্ছে ২৮৪০-২৯০০ টাকা। প্রতি কেজি চালের দাম পড়ছে ৫৮ টাকা টাকা, যা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬২-৬৩ টাকা। কোথাও আরো বেশি।

চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন, বাসমতি, মিনিকেট, কাজললতা ও স্বর্ণা ধানের দাম প্রতি মণে গড়ে ১০০-১৫০ টাকা বেড়েছে। সেই কারণে চালের বাজার সমন্বয় করা হয়েছে। এতে পাইকারিতে কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা দাম বেড়েছে।

চালের বাজারের অস্থিরতা নিয়ে কথা হয় ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সংস্থা সিসিএসের নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। চালের বাজার যারা নিয়ন্ত্রণ করে সরকার তাদের চেনে। সরকারের উচিত তাদের সঙ্গে বসে চালের দাম নির্ধারণ করা। নইলে এর বিকল্প পথ তৈরি করা।

এ প্রসঙ্গে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম ভোরের কাগজকে বলেন, চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। আগামীকাল সোমবার আমরা এই বিষয় নিয়ে একটি বৈঠক করব। এই বৈঠকে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হবে। আরো কি করা যায় এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা হবে। ওই বৈঠকে বাণিজ্য সচিবও থাকবেন। আর যারা অবৈধ মজুত করবেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবে ভোক্তা অধিদপ্তর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *