যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা দুই দেশ রাশিয়া ও চীন নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ধীরে- ধীরে দৃঢ় করছে। সম্প্রতি জাপানের সমুদ্রসীমার কাছে যুদ্ধজাহাজ নিয়ে এই দুই দেশ যৌথ মহড়া করেছে। এই দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কিলোমিটারের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।
পুতিন ও জিন পিং-এর উদ্যোগে দুই দেশের বোমাবাহী যুদ্ধবিমান জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা জোনের মধ্য দিয়ে একাধিকবার উড়ে গেছে। যার ফলে পাল্টা যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে শত্রুকে নিজেদের সীমার বাইরে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে সিওল। পুরো বিষয়টি নিয়ে গত মঙ্গলবার গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিশি নবু। টোকিওতে সাংবাদিককের কাছে তিনি বলেন, জাপানকে ঘিরে নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
জাপান যখন উদ্বেগ জানিয়ে যাচ্ছে তখন রাশিয়া ও চীনের কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে ব্যস্ত। আকাশ ও সাগরে আরও মহড়া চালানোর মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে। রাশিয়ার পক্ষে এতে স্বাক্ষর করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শইগু এবং চীনের পক্ষে স্বাক্ষর করেছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেংহে।
চুক্তি অনুযায়ী এশিয়া-প্যাসেফিক এলাকার জাপান সাগর ও পূর্ব চীন সাগরে যৌথ মহড়া চালাবে রাশিয়া ও চীন। সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও রাশিয়ার মধ্যেকার সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক স্থিতিশীলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত আগস্টে চীনের নিংশিয়া এলাকায় বড় মাত্রার সামরিক মহড়া চালানো হয়। এতে প্রথমবারের মতো চীনের মাটিতে বিদেশি হিসাবে রাশিয়ার সেনাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। শুধু যৌথ মহড়াই নয়, সেখান থেকে যৌথ উদ্যোগে হেলিকপ্টার, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও চাঁদে গবেষণা স্টেশন তৈরির ঘোষণাও করা হয়।
এ প্রসঙ্গে রাশিয়া বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র আইআইএসএস-এর গবেষক নিগেল গুড ড্যাভিস বলেন, ‘১৯৫০ এর দশকের পর এখন রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সবথেকে দারুণ সম্পর্ক বিরাজ করছে। হতে পারে দুই দেশ ইতিহাসের সবথেকে ঘনিষ্ঠ সময় পার করছে।’ চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক বিভিন্ন সময়ে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে। ১৯৬০-এর দশকে সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল। সেসময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।
তবে গুড ড্যাভিসের মতে, ‘বর্তমানে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে যে সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে তা একেবারেই আলাদা। গত ১০ বছর ধরে একটানা দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক বেড়ে চলেছে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে দ্রুততার সঙ্গে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় দেশটি।’ শুধু প্রতিরক্ষাই নয়, দুই দেশ কূটনীতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। ইরান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া ও ভেনিজুয়েলা ইস্যুতে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান একই। দুই দেশের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ও ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে দারুণ সম্পর্ক।
২০১৩ সালের পর থেকে দু’জন ৩০ বারের বেশি দেখা করেছেন। পুতিনকে নিজের ভাল বন্ধু বলে ডাকেন জিন পিং। রাশিয়া হচ্ছে চীনের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী রাষ্ট্র। একইসঙ্গে জ্বালানি তেলের জন্যেও রাশিয়ার উপরে নির্ভর করে বেজিং। অপরদিকে চীন হচ্ছে রাশিয়ার প্রধান বাণিজ্য সহযোগী রাষ্ট্র। দেশটির শক্তি খাতেও ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে রাশিয়ার। গুড ড্যাভিস মনে করেন, ‘মূলত উদারপন্থী গণতান্ত্রিক আদর্শের বিরুদ্ধে আগ্রাসী অবস্থানই চীন ও রাশিয়াকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।’
এদিকে চীন ও রাশিয়ার মধ্যেকার এই ঘনিষ্ঠতা পশ্চিমি দেশগুলোর মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দারা বলছেন, চীন ও রাশিয়ার এই সুসম্পর্ক আমেরিকা ও ন্যাটো সদস্যগুলোর জন্য ইতিহাসের সবথেকে বড় হুমকি। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকি মোকাবেলায় ১৯৪৯ সালে তৈরি করা হয়েছিল ন্যাটো। এখন জোটটি রাশিয়া ও চীন উভয় রাষ্ট্রকে নিজেদের প্রধান শত্রু মনে করে। গত মাসে লন্ডনভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টল্টেনবার্গ বলেন, তিনি রাশিয়া ও চীনকে আর আলাদা হুমকি হিসাবে দেখেন না। তিনি আরও বলেন, ‘চীন এবং রাশিয়া ঘনিষ্ঠভাবে একসাথে কাজ করে।’