দীর্ঘ ১২ বছর পর ইসরায়েলে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে। গতকাল রোববার কথিত ‘কিং অব ইসরায়েল’ বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ক্ষমতা হারিয়েছেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন আরেক কট্টর ইহুদি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতা নাফতালি বেনেত।
ইসরায়েলের ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর এখন দুটি প্রশ্ন সামনে চলে আসছে- নানা মত ও পথের সমন্বয়ে এই জোট সরকার আদৌ কতদিন টিকবে এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে নতুন এই সরকারের অবস্থান কী হবে?
নাফতালি বেনেতের রাজনৈতিক আদর্শ, তার বিশ্বাস, ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে তার অতীতের বক্তব্য-বিবৃতি বিবেচনা করলে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ আপাতদৃষ্টিতে নেই।
৪৯ বছর বয়সী নাফতালি বেনেত যে কট্টর ডানপন্থী তা নিয়ে তার কোনো রাখঢাক নেই। বিভিন্ন সময় গর্ব করে তিনি বলেছেন, নেতানিয়াহুর চেয়েও তিনি বেশি ডানপন্থী। বলতে গেলে বেনেত ইহুদি জাতীয়তাবাদ এবং জাত্যভিমানের এক প্রতীক।
বসতি-স্থাপনকারীদের নেতা
অধিকৃত পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করা গোলান মালভূমির ওপর ইসরায়েলের স্থায়ী কর্তৃত্ব এবং সার্বভৌমত্ব কায়েমের পক্ষে তিনি। কট্টর ইহুদিদের মতো তিনি বিশ্বাস করেন, ঐতিহাসিকভাবে এসব এলাকা ইসরায়েলের এবং সে কারণে পশ্চিম তীরকে তিনি সবসময় হিব্রু বাইবেলে বর্ণিত ‘জুদেয়া-সামারিয়া’ নামে অভিহিত করেন।
পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের কট্টর সমর্থক তিনি। একসময় তিনি ইহুদি বসতি-স্থাপনকারীদের সংগঠন ইয়েশা কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন। তাকে মানুষ চেনে ‘বসতি-স্থাপনকারীদের নেতা’ হিসাবে।
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোর বিরোধী তিনি। বিভিন্ন সময় তিনি ফিলিস্তিন সমস্যাকে তিনি ইসরায়েলের ‘পশ্চাৎদেশের ওপর বিষফোঁড়া’ বলে বর্ণনা করেছেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে টিভিতে এক সাক্ষাৎকারে নাফতালি বেনেত বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ আমার হাতে কোনো ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণ থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ইসরায়েলের এক সেন্টিমিটার জমি আমি ছাড়বো না।’ এমনকি ইসরায়েলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকলেও ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পক্ষপাতী তিনি।
ক্ষমতায় থাকতে বেনেত কি আপোষ করবেন
যে সাতটি দলের কোয়ালিশনে শরিক হিসাবে প্রধানমন্ত্রী হলেন বেনেত সেখানে ইসলামপন্থী একটি আরব দল ছাড়াও মেরেতজের মত বামপন্থী দল রয়েছে যারা পশ্চিম তীরে ইহুদি দখলদারিত্বে ঘোর-বিরোধী।
কীভাবে নাফতালি বেনেতের মত একজন কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিক এমন শরীকদের সাথে হাত মেলালেন তা নিয়ে সবার বিস্ময় এখনও কাটেনি। তার দলের ভেতরেও এ নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। তার বহু সমর্থক ক্ষুব্ধ। ক্ষমতায় গিয়ে কি বেনেত তার এতোদিনের আদর্শের সাথে আপোষ করবেন? ভিন্ন পথে হাঁটবেন?
জেরুজালেমে সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক হারিন্দার মিশ্র বিবিসিকে বলেন, ক্ষমতায় গিয়ে শরীকদের সাথে আপোষ করা ছাড়া হয়তো বেনেতের কোনো উপায় থাকবে না। তার মতে,‘পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি হোক বা ইসরায়েলে সমকামীদের অধিকারের প্রশ্ন হোক- যে কোনো ইস্যুতেই কোয়ালিশন শরীকদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হবে। কিন্তু সরকার টিকিয়ে রাখতে যে আপোষ করতে হবে, সেটা তারা সবাই অনুধাবন করে।’
মিশ্র বলেন ‘দুটো ভীতির’ কারণে এই কোয়ালিশন হয়তো টিকে থাকতে পারে এবং বেনেতকে অনেক বিষয়ে নমনীয় হতে দেখা যেতে পারে- ‘প্রথম কথা বেনেত এবং শরীকরা জানেন তাদের ভেতর মত-পার্থক্য চরমে গেলে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় ফিরে আসবেন। দ্বিতীয়ত, এই শরীকে যোগ দিয়ে বেনেত নিজে বিরাট ঝুঁকি নিয়েছেন। তার সমর্থকরা ক্ষুব্ধ। সুতরাং এই সরকার যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে ইসরায়েলের রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারেন বেনেত। ফলে সেই ভয়েই তিনি আপোষ করবেন বলে আমার ধারণা। আপোষ তাকে করতেই হবে।’
তবে, পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতি এবং ফিলিস্তিনিদের সাথে আলোচনা শুরুর মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নতুন সরকার এখন এড়িয়ে চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু বেনেত যে আপোষে প্রস্তুত তার কিছুটা ইঙ্গিত ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে।
গত শুক্রবার কোয়ালিশনের মধ্যে চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার পর নাফতালি বেনেত বলেন, তার সরকার ইসরায়েলের সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে কাজ করবে। ধার্মিক, ধর্ম-নিরপেক্ষ, অতি-ধার্মিক, আরব- সবার জন্য সমানভাবে সরকার কাজ করবে। আমার বিশ্বাস আমরা সফল হবো।