আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের নতুন অভিযোগগুলোর তদন্ত ও বিচারের আহ্বান জানিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সংস্থাটি জানায়, দশ বছর আগে ভারত সরকার ‘ট্রিগার হ্যাপি’র ঘোষণা দেয়। সেখানে বলা হয়েছিল, বিএসএফ সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণনাশী গুলির পরিবর্তে রাবার বুলেট ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হবে।
কিন্তু, ভারত ও বাংলাদেশের এনজিওগুলোর বরাতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে বিএসএফ সীমান্তে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের বাসিন্দার ওপর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, দুর্ব্যবহার ও অসদাচরণ করে যাচ্ছে। তবে গবাদি পশু চোরাচালান ও অবৈধ অনুপ্রবেশরোধে নিয়োজিত বিএসএফ সদস্যরা জানিয়েছেন, তাদের ওপর আক্রমণ এলেই তারা শক্তি প্রয়োগ করেন।
গুগলে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। সংখ্যার দিক থেকে সীমান্তে প্রাণহানিতে বিশ্ব রেকর্ডটি আমাদেরই। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে হতাহতের সবাই না হলেও অন্তত ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশি।
কিছুদিন পর পর সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে খবর চোখে পড়লেও বিষয়টি যে একটা বিশ্ব রেকর্ডে দাঁড়িয়েছে, সেটা প্রথম গণমাধ্যমের নজরে আসে বছর চারেক আগে ব্রিটেনের চ্যানেল ফোর-এর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের এই আচরণ যে এতটা ভয়াবহ এবং গুরুতর রূপ নিয়েছে, সেটা বুঝতে না পারার কারণ প্রধানত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা।
সামগ্রিকভাবে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় সন্দেহভাজনদের হত্যার বিষয়টিকে যে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের প্রাতিষ্ঠানিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে, সেটা বুঝতে আমাদের সময় লেগেছে অনেক। ‘ইন্ডিয়া’স গ্রেট ওয়াল দ্য ওয়ার্ল্ডস ডেডলিয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি প্রচারিত হয় ২০০৯ সালের ২৩ জুলাই।
চ্যানেল ফোরের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সংবাদদাতা জোনাথন রাগম্যানের প্রায় সাড়ে আট মিনিটের এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি ইন্টারনেটে এখনো পাওয়া যায়। তাঁর প্রতিবেদনে তিনি দেখিয়েছেন যে সীমান্তে হতাহত ব্যক্তিদের সবাই গরু পাচারকারী অথবা চোরাকারবারি নন।
এসব অবৈধ কারবারে কেউ কেউ নিশ্চয়ই জড়িত, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দুর্ভোগ এবং বিপদের শিকার হচ্ছেন সীমান্ত এলাকার সাধারণ কৃষক এবং তাঁদের পরিবারগুলো। চাষাবাদের কাজ করার সময় বিএসএফের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন অথবা গুলি খেয়ে বেঁচে গেছেন এ রকম বেশ কিছু গ্রামবাসীর সাক্ষাৎকার রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। অভিন্ন নদীর প্রবাহে সীমান্ত বিভাজন হয়েছে এ রকম তিস্তার এক অংশে নৌকায় বাংলাদেশি নারীদের একটি দলকে পাচারের দৃশ্যও তাঁর প্রতিবেদনে রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘সীমান্ত বাহিনীর সংযত আচরণ ও মারণাস্ত্র ব্যবহার সীমিত রাখার ভারত সরকারের আদেশের পরেও হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও অন্যান্য গুরুতর অপরাধ কমেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহি করতে সরকারের ব্যর্থতা একে আরও খারাপ পর্যায়ে নিয়ে গেছে এবং এতে দরিদ্র ও দুর্বল জনগোষ্ঠী নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, সীমান্তে সংযত থাকা ও হত্যাকাণ্ডের অবসান ঘটাতে ভারত সরকার আদেশ জারির পর, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে আলোচনার সময়ও এ বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে। তবে, বাংলাদেশি মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ অভিযোগ করেছে ২০১১ সাল থেকে সীমান্তরক্ষী বাহিনী অন্তত ৩৩৪ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে এবং ২০২০ সালে ৫১টি হত্যাসহ গুরুতর নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছে।
একটি ভারতীয় সংস্থা বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (এমএসইউএম) বলেছে, ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বিএসএফ কমপক্ষে ১০৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হত্যার প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
সংস্থাটি আরও জানায়, বিএসএফ সেনারা নির্বিচারে সন্দেহভাজনদের আটক করে নির্যাতন করে এবং সীমান্তবর্তী এলাকার ভারতীয় বাসিন্দাদের হয়রানি ও হুমকি দেয়।
সাম্প্রতিক সময়ে অভিযোগের মধ্যে কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এর মধ্যে ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায় বিএসএফ সৈন্যরা ১৬ বছর বয়সী শমসের প্রামাণিককে মারধর করে ও পরে গুলি করে হত্যা করে। শমসের সে সময় সীমান্ত পেরিয়ে গরু নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। ২০২০ সালের ৯ আগস্ট বিএসএফের এক সৈনিক কুচবিহার জেলায় সাহিনুর হককে (২৩) গুলি করে হত্যা করে বলে অভিযোগ আছে।
কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, ২০২০ সালের ১৯ এপ্রিল বিএসএফের এক সৈনিক বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলার ১৬ বছর বয়সী বাংলাদেশি ছেলে সিমন রায়কে হত্যা করে। বিএসএফ সেনা বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভেতরে ঢুকে ছেলেটিকে পেটে গুলি করে বলে অভিযোগ করে সিমনের বাবা।
২০২০ সালের ৪ জুলাই বিএসএফ সেনারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৫০ বছর বয়সী এক বাংলাদেশিকে গুলি করে বলে অভিযোগ আছে। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি জানান, লোকটি গবাদি পশুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়ে অজান্তে সীমান্ত অতিক্রম করার পরে বিএসএফ সদস্যরা তাকে হত্যা করে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও নেতাকর্মীরা এসব আইন লঙ্ঘনের ঘটনায় অভিযোগ করা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার চেষ্টা করলে তাদেরকে হুমকি ও ভয় দেখানো হয়েছে। এমএসইউএম কর্মীরা জানান, তারা পুলিশ ও বিএসএফের কাছ থেকে নিয়মিত হয়রানির শিকার হন। তাদেরকে বিনা বিচারে আটকে রাখা হয় এবং মিথ্যা অপরাধের অভিযোগ দেওয়া হয় তাদের বিরুদ্ধে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ বারবার সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছে। গত বছর আগস্টে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সীমান্ত হত্যা সম্পর্কে উদ্বেগের কথা জানায়। মন্ত্রণালয় বলে, ‘বাংলাদেশের কাছে এটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির লঙ্ঘন এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযত আচরণের আহ্বান জানাচ্ছে।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জানামতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিএসএফ সেনাদের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নির্যাতনের জন্য দায়ী করেছে এমন কোনো ঘটনা জানা নেই।
এর মধ্যে, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে বিএসএফ এর এক বাংলাদেশি কিশোরী ফেলানী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০১৩ ও ২০১৫ সালে বিশেষ বিএসএফ আদালতে দুই দফায় বিচার হয়। তবে, আদালত ওই ঘটনায় অভিযুক্ত বিএসএফ কনস্টেবলকে খালাস দেন। মামলায় নতুন করে তদন্তের আবেদন এখন ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মুলতবি আছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কিত জাতিসংঘের মূলনীতি মেনে নেওয়ার বিষয়ে ভারত সরকারের কাজ করা উচিত। এতে কেবল প্রাণ রক্ষার জন্য চূড়ান্ত শক্তি ব্যবহারের অনুমতি আছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বিএসএফের অভ্যন্তরীণ বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণে, প্রশাসনের উচিত গুরুতর অধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পদের সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা এবং তাদেরকে বেসামরিক আদালতে বিচার করা।