নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়াই ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, শিগগিরই চুক্তি সম্পন্ন হবে।

আন্তর্জাতিক

### যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন খনিজ চুক্তি: নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ছাড়াই আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে

ইউক্রেন জানিয়েছে, দেশটির খনিজ সম্পদ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি শিগগিরই সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। তবে এই চুক্তির বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে কোনো নির্দিষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম *দ্য গার্ডিয়ান*।

ট্রাম্পের মতে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বিরল খনিজসম্পদ সম্পর্কিত একটি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আগামী শুক্রবার হোয়াইট হাউসে যাবেন। তবে এই চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে না। ট্রাম্প আরও দাবি করেছেন, এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে সামরিক সহায়তায় ব্যয় হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ পুনরুদ্ধার করতে পারবে।

### নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়ে বিতর্ক

চুক্তিটি চূড়ান্ত করার জন্য কয়েক দিন ধরে আলোচনা চলেছে। আলোচনার সময় জেলেনস্কি বিশেষভাবে চেয়েছিলেন, রাশিয়ার চলমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যেন ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেয়। তবে এই চুক্তির নির্দিষ্ট শর্তাবলী এখনও স্পষ্ট নয়। চুক্তির খসড়ায় একটি যৌথ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের খনন থেকে অর্জিত রাজস্ব সংরক্ষণ করা হবে। একইসঙ্গে, তেল ও গ্যাস বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থও এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন পাসে অবস্থিত মলিকর্পের বিরল খনিজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে সেরিয়াম অক্সাইড, বাস্টনাসাইট, নিওডিমিয়াম অক্সাইড এবং ল্যান্থানাম কার্বোনেটের নমুনা প্রদর্শন করা হয়েছে। ট্রাম্প ইতিপূর্বে ঘোষণা করেছিলেন, ইউক্রেন যদি মার্কিন সামরিক সহায়তা চায়, তবে তাকে বিরল খনিজ পদার্থ সরবরাহ করতে হবে। ইউক্রেন অবশেষে এই শর্ত মেনেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ইউক্রেনের আপত্তি ও চুক্তির পরিবর্তন

গত বুধবার মার্কিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট শুক্রবার ওয়াশিংটনে এসে চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন। তিনি এটিকে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি’ বলে অভিহিত করেন।

মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের ওপর চুক্তির খসড়া স্বাক্ষরের জন্য চাপ প্রয়োগ করেছিল বলে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রাথমিক খসড়ায় যৌথ তহবিলের মালিকানা পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রাখার কথা ছিল, তবে জেলেনস্কি এর বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এমন কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করব না, যার বোঝা ভবিষ্যতের ১০ প্রজন্মের ইউক্রেনীয়দের বইতে হবে।’

পরবর্তীতে আলোচনায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়। ইউক্রেন দীর্ঘমেয়াদে তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি চেয়েছিল। ট্রাম্পের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমি খুব বেশি নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে যাচ্ছি না। আমরা চাই ইউরোপ এ বিষয়ে দায়িত্ব নিক।’

ন্যাটো প্রসঙ্গে ট্রাম্পের মন্তব্য

ট্রাম্প ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ পাওয়ার ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, ‘ন্যাটো নিয়ে ভাবার দরকার নেই। সম্ভবত এ কারণেই পুরো সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে।’ বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চুক্তির খসড়ায় নিরাপত্তা নিশ্চয়তা সংক্রান্ত অস্পষ্ট ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।

জেলেনস্কি চুক্তিটিকে ‘প্রাথমিক কাঠামো’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এটি কেবল শুরু, তবে ভবিষ্যতে বড় সাফল্যে পরিণত হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, যদি তিনি হোয়াইট হাউসে যান, তবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সরাসরি জানতে চাইবেন, তারা ইউক্রেনকে কতটা সমর্থন দেবে। জেলেনস্কির মতে, ‘যদি আমরা নিরাপত্তা নিশ্চয়তা না পাই, তবে অস্ত্রবিরতি সম্ভব নয়। কিছুই কার্যকর হবে না।’

রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া

জেলেনস্কির মন্তব্যের আগে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, ইউক্রেনে ইউরোপীয় শান্তিরক্ষী সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব মস্কো প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি ট্রাম্পের বক্তব্যের বিরোধিতা করে জানান, ভ্লাদিমির পুতিন পশ্চিমা সামরিক উপস্থিতিকে সমর্থন করেন না।

লাভরভ আরও বলেন, ‘ট্রাম্প বলেছেন, শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন তখনই সম্ভব হবে, যদি উভয় পক্ষ—আমরা এবং ইউক্রেন—এতে সম্মত হয়। কিন্তু কেউ আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেনি।’

এদিকে, আগামী রোববার লন্ডনে ইউরোপীয় নেতাদের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে বৈঠকের কথা রয়েছে। সেখানে ইউক্রেনে ইউরোপীয় সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সমর্থিত এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, অস্ত্রবিরতির পর ইউক্রেনে ৩০ হাজারের কম সেনা মোতায়েন করা হতে পারে, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে না গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে।

লাভরভ এই প্রস্তাবকে ‘প্রতারণা’ আখ্যা দিয়ে দাবি করেন, এটি ইউক্রেনকে আরও বেশি অস্ত্র দিয়ে পূর্ণ করার একটি কৌশল, যা দেশটিকে ন্যাটোর দিকে আরও ঠেলে দেবে এবং রুশভাষীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করবে।

যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া আলোচনা

আজ বৃহস্পতিবার তুরস্কের ইস্তাম্বুলে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। এটি দুই দেশের মধ্যে টানা দ্বিতীয় সপ্তাহের বৈঠক। এর আগে, সৌদি আরবের রিয়াদে দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বৈঠক করেছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে এই আলোচনা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও গত সপ্তাহে জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ওয়াশিংটন ও মস্কোতে তাদের কূটনৈতিক মিশন পুনরায় চালুর পরিকল্পনা করছে, যা ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির আলোচনার অংশ। তবে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে মস্কো এখনও অনড় অবস্থানে রয়েছে।

রাশিয়ার কৌশল ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

মস্কো এখনও ইউক্রেনের চারটি সংযুক্ত অঞ্চল সম্পূর্ণভাবে দখলে নিতে চায় বলে লাভরভ পুনরায় জানিয়েছেন। তিনি ইঙ্গিত দেন, রাশিয়া ইউক্রেনের রাজনৈতিক ভবিষ্যতেও প্রভাব বজায় রাখতে চায়।

ক্রেমলিন দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে যে, ইউক্রেন সরকার রুশভাষীদের দমন করছে, যা ২০২২ সালে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের মূল কারণ। তবে ইউক্রেন বারবার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

চলমান এই উত্তেজনার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেনের খনিজ চুক্তির ভবিষ্যৎ এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *