কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা মডেল মসজিদটি উদ্বোধন হয় ২০২১ সালে ১০ জুলাই। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রায় তিন লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল দেওয়া হয়। এরপর আর বিল দিতে পারেনি মসজিদ কর্তৃপক্ষ। ২৩ মাসে সেখানকার বিদ্যুৎ বিল জমে ১০ লাখ টাকার বেশি হয়েছে। এই বিল নিয়ে মসজিদ ও পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ উভয়ই বিপাকে পড়েছে।
মডেল মসজিদগুলোর দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের বেতন দেয় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু মডেল মসজিদ পরিচালনার নীতিমালা অনুযায়ী বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ মানুষের দানের টাকা থেকে মসজিদ কর্তৃপক্ষকেই নির্বাহ করতে হয়।
দাউদকান্দি উপজেলা মডেল মসজিদের দায়িত্বরত কর্মকর্তা এম এ সাত্তার বলছিলেন, “প্রতি মাসে গড়ে ৪০ হাজার টাকার বেশি বিদ্যুৎ বিল আসে। গরমকালে আরো বেশি আসে। বিদ্যুৎ বিল ছাড়াও মসজিদের অন্যান্য কাজের টাকাও মানুষের দান করা টাকা থেকে ব্যয় করতে হয়।
“কিন্তু দানবাক্সে এত টাকা জমে না। সে কারণে বিদ্যুৎ বিল জমে জমে ১০ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বিল দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।”
তিনি জানান, মডেল মসজিদগুলোতে ‘বাণিজ্যিক’ বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়ার কারণে বিল আরও বেশি আসছে।
দাউদকান্দি উপজেলা মডেল মসজিদে ইমাম, মুয়াজ্জিনসহ তিনজন কর্মরত আছেন। ইমাম ও মুয়াজ্জিনের বেতন মসজিদ ফান্ড থেকেই হয়।
কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনতলা মসজিদটিতে ৪০টি ফ্যান, আটটি দুই টনের এসি, পানির মোটর, ঝাড়বাতিসহ বিভিন্ন ধরনের ১০০টির মত বাল্ব রয়েছে।
কুমিল্লার ১৭টি উপজেলার মধ্যে আটটিতে মডেল মসজিদ চালু হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এসব মসজিদে সাড়ে ৪০ লাখ টাকার বেশি বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে।
মডেল মসজিদের বিদ্যুৎ বিলের এই সমস্যা শুধু কুমিল্লা জেলাতেই নয়; বরং অনেক স্থানেই তৈরি হয়েছে।
ফেনী, নেত্রকোণা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, রংপুর, দিনাজপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলায় খোঁজ নিয়ে প্রায় একই চিত্র পাওয়া গেছে। মসজিদগুলোর লাখ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল আটকে আছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ ফেরদৌস-উজ-জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা আসলে সত্যিকার অর্থেই সমস্যা। বলা আছে যে স্থানীয় উৎস থেকে বিদ্যুৎ বা এ ধরনের ব্যয় বহন করতে হবে। সরকার এত টাকা দিচ্ছে নাকি?
“সরকার থেকে ১০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছে। বাকিটা পাবলিকের, মসজিদের দানবাক্স থেকে দিতে হবে। কারণ, এই মুহূর্তে টাকার ক্রাইসিসও আছে কিছুটা। আমাদের কাছে প্রকল্প বুঝিয়ে দেওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব। বিদ্যুৎ বিলের ব্যাপারটা আমাদের দায়িত্ব না।”
যে কারণে সংকট
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সারাদেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রকল্পের খরচ ধরা হয় আট হাজার ৭২২ কোটি টাকা।
প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী, মডেল মসজিদের জন্য ৪০ শতাংশ জায়গার প্রয়োজন। জেলা পর্যায়ে চারতলা ও উপজেলার জন্য তিনতলা এবং উপকূলীয় এলাকায় চারতলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণের কথা বলা হয়।
মডেল মসজিদে নারী-পুরুষের পৃথক অজু ও নামাজের স্থান, পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, হজ যাত্রীদের নিবন্ধন, পর্যটকদের আবাসন ব্যবস্থা, দাওয়াতি কার্যক্রম, হিফজ মাদ্রাসা, মক্তব, মৃত ব্যক্তির গোসলের ব্যবস্থা, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনের আবাসন প্রকল্পসহ বহুমুখী ইসলামি কার্যক্রম ও সেবার কথা বলা আছে।
দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছিলেন, মসজিদগুলো নির্মাণ করা হয়েছে মূল শহর থেকে একটু দূরে। ফলে সেখানে প্রতি ওয়াক্তে নামাজের জন্য লোকজন কম হয়। সাধারণত যারা নামাজে আসেন, প্রতিনিয়ত তারাই দান করেন। কম লোক আসায় দানের টাকাও কম হয়। যে কারণে, বিদ্যুৎ বিল দেওয়া ও অন্যান্য খরচ মেটাতে সমস্যা হচ্ছে।
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা মডেল মসজিদে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল বাবদ বকেয়া পড়েছে সাত লাখ ২৪ হাজার ৬৫২ টাকা।
বুড়িচংয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার বলেন, “মসজিদের নিজস্ব কোনো আয়ের ব্যবস্থা নেই, মানুষের দানের টাকা থেকে ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। মসজিদে বেশি মানুষ সমাগম না হলে দানের টাকাও বাড়বে না। এ কারণে বিদ্রুৎ বিল বকেয়া পড়েছে।
“এ নিয়ে আমরা বিপাকে আছি। জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে কিছুটা সহযোগিতা করা হলেও বিদ্যুৎ বিভাগ বিল পরিশোধের জন্য প্রতিনিয়ত চাপ দিচ্ছে।”
কুমিল্লা জেলায় মোট ১১টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করা হয়েছে। নিয়মিত নামাজ শুরু হয়েছে নয়টিতে। এর মধ্যে আটটি মসজিদেই বিদ্যুৎ বিল বকেয়া হয়েছে ৪০ লাখ ৬৪ হাজর ৩০৬ টাকা।
কুমিল্লা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন বলেন, “শুধু দানের টাকায় এত বড় কমপ্লেক্স ভবনের প্রতি মাসের বিদ্যুৎ বিল, পরিছন্নতা এবং অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ সম্ভব নয়।”
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দাউদকান্দি উপজেলা মডেল মসজিদে ১০ লাখ ৯৯০ টাকা, জেলা মডেল মসজিদে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৪২ টাকা, বুড়িচং উপজেলা মডেল মসজিদে সাত লাখ ২৪ হাজার ৬৫২ টাকা, নাঙ্গলকোট উপজেলা মডেল মসজিদে তিন লাখ ৩৭ হাজার ৭৪১ টাকা, চান্দিনা উপজেলা মডেল মসজিদে ছয় লাখ ৫৭ হাজার ৯৪৮ টাকা, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা মডেল মসজিদে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার ৬৮৪ টাকা, দেবিদ্বার মডেল মসজিদে ৮৬ হাজার ৬৪৯ টাকা এবং চৌদ্দগ্রাম উপজেলা মডেল মসজিদে ৫৫ হাজার টাকা বৈদ্যুতিক বিল বকেয়া পড়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর জেনারেল ম্যানেজার মো. নুরুল হোসাইন বলেন, “মডেল মসজিদগুলোর বৈদ্যুতিক সংযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। বৈদ্যুতিক সংযোগগুলো কীভাবে পরিবর্তন করা যায় আমরা তার ব্যবস্থা করছি। তবে মডেল মসজিদগুলোতে বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ বাড়ছে।”
অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলের চাপ কমাতে মডেল মসজিদগুলোর বৈদ্যুতিক সংযোগে লোড কমানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার।
তিনি বলেন, “মডেল মসজিদগুলো এমন জায়গায় যে সেখানে কোনো বাণিজ্যিক ব্যবস্থা করেও এসব বকেয়া নির্বাহের সুযোগ নেই। সুতরাং, দানের টাকার উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে এসব খরচের জন্য। আমরা জেলা প্রশাসন থেকে কিছুটা সহযোগিতা করছি, এর বাইরে আসলে কিছুই করার সুযোগ নেই।”
প্রতি ওয়াক্তে ‘গড়ে ছয়-সাতজন’ নামাজ পড়েন
২০২৩ সালের ৩০ জুলাই ফেনীর ছাগলনাইয়া মডেল মসজিদের কার্যক্রম শুরু হয়। মসজিদের পাশে একটি পল্লী বিদ্যুতের সাবস্টেশান থাকায় সেখান থেকে সংযোগ দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ৯৬ হাজার টাকার বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এখনও প্রায় এক লাখ ৩৫ লাখ টাকার বিল বকেয়া।
ছাগলনাইয়া মডেল মসজিদের ফিল্ড সুপারভাইজার শামসুল ইসলাম জাকারিয়া বলেন, অপরিশোধিত বিল নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও পল্লী বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষে সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। মসজিদের পাশে সাবস্টেশন লাইন চার্জ ১০ হাজার টাকা কমালে বিদ্যুৎ বিল কম আসবে।
মসজিদের ইমাম মাওলানা মনজুরুল মাওলা সর্দার বলেন, মসজিদে প্রতি ওয়াক্ত কমবেশি নামাজি আসেন। মাসে গড়ে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা নামাজিদের কাছ থেকে সংগ্রহ হয়। আর মসজিদে প্রতি মাসে গড়ে ২৫ থেকে ২৮ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল আসে।
ফেনী জেলা মডেল মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী সদর উপজেলার ফতেহপুর এলাকায়। শহর থেকে একটু দূরে হওয়ায় মসজিদে প্রতি ওয়াক্ত মানুষ তেমন হয় না।
জেলা মডেল মসজিদের খতিব মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, “মসজিদের পুরো কাজ এখনও শেষ হয়নি। ঠিকাদার এখনও কর্তৃপক্ষকে কাজ বুঝিয়ে দেয়নি। তবে মসজিদে নামাজসহ সব কাজ চলে। প্রতি ওয়াক্তে গড়ে ছয় থেকে সাতজন নামাজ পড়েন।”
বিদ্যুৎ বিলের বিষয়ে জানতে চাইলে খতিব বলেন, যেহেতু মসজিদটির কাজ শেষ করে ঠিকাদার বুঝিয়ে দেয়নি সেহেতু বিদ্যুৎ বিল তারাই দিচ্ছে।
সিরাজগঞ্জে ৩ মসজিদের বকেয়া সাড়ে ২০ লাখ টাকা
সিরাজগঞ্জ জেলা ও নয় উপজেলায় মোট ১০টি মডেল মসজিদ নির্মাণের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তিনটিতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই তিনটি বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে ২০ লাখ ৬৯ হাজার ৫০৯ টাকা।
সিরাজগঞ্জ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফারুক আহম্মেদ বলেন, ২০২১ সালের ১০ জুন জেলা মডেল এবং সদর উপজেলা মডেল মসজিদ উদ্বোধন হয়। এরপর থেকে এ দুটি মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়ানো হচ্ছে।
জেলা মডেল মসজিদ ও একই ভবনে অবস্থিত জেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ের বিদ্যুৎ বিল এসেছে আট লাখ ৭৩ হাজার ৫৪০ টাকা। পরিশোধ করা হয়েছে দুই লাখ ৫২ হাজার ৪৭১ টাকা। আর বাকি পড়েছে ছয় লাখ ২১ হাজার ৬৯ টাকা।
সদর উপজেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে বিদ্যুৎ বিল এসেছে ১১ লাখ ২৪ হাজার ৬৭০ টাকা। পরিশোধ করা হয়েছে দুই লাখ ৭০০ টাকা। বাকি রয়েছে নয় লাখ ২৩ হাজার ৯৭০ টাকা।
এ ছাড়া কাজীপুর উপজেলা মডেল মসজিদটি ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধনের পর থেকেই নামাজ পড়ানো হচ্ছে। এই মসজিদ ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে এ পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল এসেছে ছয় লাখ ৫৪ হাজার ৯২ টাকা। পরিশোধ করা হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ৬২২ টাকা। বাকি রয়েছে পাঁচ লাখ ২৪ হাজার ৪৭০ টাকা।
তাড়াশ উপজেলা মসজিদটি ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর উদ্বোধন করা হলেও গণপূর্ত অধিদপ্তর স্থাপনা বুঝিয়ে না দেওয়ায় এখনো নামাজ পড়ানো শুরু হয়নি। আর রায়গঞ্জ উপজেলা মসজিদটি নির্মাণ কাজ শেষে উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে।
বাকি পাঁচটির মধ্যে বেলকুচি, চৌহালী ও কামারখন্দ উপজেলা মডেল মসজিদ নির্মাণার্ধীন অবস্থায় রয়েছে। উল্লাপাড়া উপজেলা মডেল মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হলেও মাঝপথে নির্মাণ-ক্রটির কারণে ঠিকাদার কাজ ফেলে চলে যাওয়ায় সেটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আর জায়গা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে শাহজাদপুর মডেল মসজিদের নির্মাণ কাজ এখনো শুরু হয়নি।
সিরাজগঞ্জ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফারুক আহম্মেদ বলেন, বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের জন্য সিরাজগঞ্জ নেসকো ও কাজিপুর পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয় থেকে বার বার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়েছে।
“এরই মধ্যে বিল সাশ্রয় করার জন্য মসজিদগুলোর লোড কমিয়ে আনা এবং কার্যালয়গুলোর বিল অফিসিয়ালি আলাদাভাবে দেওয়ার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।”
সিরাজগঞ্জ জেলা মডেল মসজিদের ইমাম তারিকুল ইসলাম বলেন, “সরকারি মসজিদ হওয়ায় নামাজিরা দান করতে তেমন আগ্রহ দেখান না। দানশীল ব্যক্তিরাও কোনো সহযোগিতা করেন না। প্রতি জুম্মায় দানবাক্সে এক হাজার থেকে ১২০০ টাকা জমা হয়। মাস শেষে গিয়ে দাঁড়ায় সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা। অথচ প্রতি মাসে মসজিদ ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যালয় মিলে বিদ্যুৎ বিল আসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা।”
তিনি বলেন, প্রতি মাসে জেলা মডেল মসজিদের ইমামকে ১৫ হাজার, মোয়াজ্জিনকে ১০ হাজার ও কর্মরত দুইজন খাদেমকে জনপ্রতি সাড়ে সাত হাজার টাকা করে সরকারিভাবে বেতন দেওয়া হয়।
“এটা তুলনামুলক অনেক কম। এজন্য সরকারি স্কেলভিত্তিক বেতন দেওয়ার দরকার।”
রংপুরে সব মসজিদের বিল বাকি
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের রংপুর বিভাগের পরিচালক মোস্তফা মনছুর আলম বলেন, রংপুর বিভাগের মডেল মসজিদের বিদ্যুৎ বিল দেওয়া হত একটি প্রকল্প থেকে। এখন আর সেই প্রকল্প থেকে দেওয়া হয় না। বিভাগের সব জেলা ও উপজেলার মডেল মসজিদের বিদ্যুৎ বিল বাকি আছে। ১৬ জানুয়ারি বিল নিয়ে সভায় উপস্থাপন করা হয়েছে এবং উপরে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি রংপুর বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, “আমরা তো মডেল মসজিদের ঠিকমত বিদ্যুৎ বিল পাই না। অনেক টাকা বাকি আছে। আমরা মডেল মসজিদ কর্তৃপক্ষকে বারবার চিঠি দিয়ে তাগাদা দিচ্ছি কিন্ত কোনো কাজ হয় না।
“মডেল মসজিদ কর্তৃপক্ষও এ নিয়ে সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছে। আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে তো বিল দিতে হবে।”
দিনাজপুরে ৬ মসজিদে বকেয়া ২৯ লাখ
দিনাজপুরে ১৪টি মডেল মসজিদের মধ্যে ছয়টিতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিটি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। এই ছয়টিতে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে প্রায় ২৯ লাখ টাকা।
বিরল, খাসনামা, পার্বতীপুর, ঘোড়াঘাট, হাকিমপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলা মডেল মসজিদে নামাজ পড়া শুরু হয়েছে। বাকি আটটি নির্মাণাধীন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন দিনাজপুর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মশিউর রহমান জানান, প্রতিটি মসজিদে গড়ে মাসে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল আসছে। মসজিদের সব ব্যবস্থাপনা চালু হলে বিল আরও বাড়বে।
বিরল উপজেলায় প্রায় ১০ লাখ টাকা, খানসামায় প্রায় সাত লাখ টাকা, পার্বতীপুরে সাড়ে চার লাখ টাকা, নবাবগঞ্জে দেড় লাখ টাকা, ঘোড়াঘাটে দেড় লাখ টাকা এবং হাকিমপুরে সাড়ে চার লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে।
মশিউর রহমান বলেন, বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অবহিত করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করা হবে।
দিনাজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার আখতার হোসেন বলেন, “এ নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বিদ্যুতায়ন বোর্ডেও আলোচনা হচ্ছে। মডেল মসজিদের বিদ্যুৎ বিল নিয়ে সারাদেশে যেহেতু সমস্যা বিদ্যমান, সেহেতু নিশ্চয় সরকার একটা সমাধানে নিয়ে আসবে।”
নরসিংদী জেলার তিনটি মডেল মসজিদের মধ্যে সদর ও শিবপুর উপজেলা মডেল মসজিদের উদ্বোধন করা হয় ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি। আর শিবপুর উপজেলা মডেল মসজিদের উদ্বোধন হয় একই বছরের ১৬ অক্টোবর।
জেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, তিনটি মডেল মসজিদে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল এসেছে ১৭ লাখ ১৭ হাজার ৯৫৯ টাকা। এ পর্যন্ত পরিশোধ করা হয়েছে ১১ লাখ ১৫ হাজার ১৯৪ টাকা। বকেয়া পড়েছে মোট ৬ লাখ ২ হাজার ৭৬৫ টাকা।
এরমধ্যে নরসিংদী সদর মডেল মসজিদে বিদ্যুৎ বিল এক লাখ ৯০ হাজার ৩৩৭ টাকা, শিবপুর মসজিদে ৪৩ হাজার ৮৭৪ টাকা এবং মনোহরদী মডেল মসজিদে তিন লাখ ৬৮ হাজার ৫৫৪ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে।
এ ছাড়া গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে আরও চার মাসের নতুন হিসাব করা হলে তিনটি মসজিদে গড়ে মোট চার লাখ টাকার কমবেশি বিদ্যুৎ বিল যোগ হতে পারে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নরসিংদীর উপ-পরিচালক মো. ইউসুফ বলেন, মডেল মসজিদে গড়ে প্রতি সপ্তাহে দান থেকে আয় হয় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। শিবপুর ও মনোহরদী মডেল মসজিদে সপ্তাহে এ দানের পরিমাণ হয় গড়ে এক থেকে দেড় হাজার টাকা।
“শুধু দানের টাকায় এত বড় মসজিদের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা সম্ভব হয় না, সংকট থেকেই যায়। গরমকালে বিদ্যুৎ বিল অনেক বেড়ে যায়।”
নারায়ণগঞ্জ জেলার পাঁচ উপজেলায় পাঁচটি এবং জেলা পর্যায়ে একটি; মোট ছয়টি মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প ছিল। এরমধ্যে কেবল কাজ সমাপ্ত হয়েছে সোনারগাঁ উপজেলা মডেল মসজিদের। সম্পূর্ণ কাজ শেষ না হলেও নামাজ আদায়ের কার্যক্রম চলছে রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার উপজেলা মসজিদে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জেলা কার্যালয়ের ফিল্ড সুপারভাইজার মো. সাইফুদ্দিন জানান, রূপগঞ্জ উপজেলা মডেল মসজিদের প্রায় ৭০ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে। অন্যদিকে সোনারগাঁ উপজেলা মডেল মসজিদের বিদ্যুৎ বিল গত কোরবানির ঈদের আগে পরিশোধ করা হয়েছিল। তখন থেকে এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল কয়েক হাজার টাকা বকেয়া পড়েছে।
অন্য মসজিদগুলো এখনও নির্মাণাধীন; সেগুলো ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাছে এখনও হস্তান্তর না হওয়ায় সে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের দায়িত্ব নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তরের।
নেত্রকোণা জেলায় চারটি মডেল মসজিদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে; আর দুটি নির্মাণাধীন।
জেলা পল্লী বিদ্যুতের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) প্রকৌশলী মাসুদ আহমেদ বলেন, কেন্দুয়া, মদন, মোহনগঞ্জ ও বারহাট্টা উপজেলা মডেল মসজিদের বিদ্যুৎ বিল নভেম্বর পর্যন্ত ১৫ লাখ টাকা ছিল। এখন সেটা আরও প্রায় ৫০ হাজারের মত বেড়েছে।
খালিয়াজুড়ী ও কলমাকান্দা উপজেলায় মডেল মসজিদ এখনও নির্মাণাধীন। সেগুলো সংযোগ দেওয়া হয়নি।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক মাছুম কামাল, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি ইসরাইল হোসেন বাবু, নরসিংদী প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান রিপন, দিনাজপুর প্রতিনিধি মোর্শেদুর রহমান আঙ্কারা, নেত্রকোণা প্রতিনিধি লাভলু পাল চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি সৌরভ হোসেন সিয়াম, ফেনী প্রতিনিধি নাজমুল হক শামীম, রংপুর প্রতিনিধি আফতাবুজ্জামান হিরু।)