সিরিয়ায় লাখো গুম-খুনের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল বাপ-বেটার ৫৪ বছরের শাসন

আন্তর্জাতিক

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের পতন হয়েছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারের। আল-আসাদ একটি উড়োজাহাজে করে দামেস্ক ছেড়ে অজানা গন্তব্যে চলে গেছেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এর মধ্য দিয়ে, সিরিয়ায় আল-আসাদ পরিবারের প্রায় ৫৪ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে।

বাশার আল-আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদ ১৯৭০ সাল থেকে ২০০০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সামরিক আধিপত্য, রাজনৈতিক কৌশল এবং নির্মম দমননীতি ব্যবহার করে তিনি দেশটিকে এক প্রকারের বন্দীশালায় পরিণত করেছিলেন।

শিয়া গোষ্ঠী আলাওয়ি বা আলভি সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করা হাফিজ আল-আসাদ জীবনের প্রথমভাগে সিরিয়ার সামরিক বাহিনীতে অবস্থান শক্তিশালী করেন। বিশেষ করে ১৯৬০-এর দশকে দেশের সাম্প্রদায়িক ক্ষমতার লড়াইয়ের সময় তিনি প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।

পরে তিনি সিরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বিমানবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১৯৬৬ সালে বাথ পার্টির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। এটি ছিল সিরিয়ায় ১৭ বছরের মধ্যে দশম সামরিক অভ্যুত্থান। তবে এই অভ্যুত্থান দেশটিতে এক ধরনের ‘ভঙ্গুর’ স্থিতিশীলতা এনে দেয়।

আসাদ তার ক্ষমতা সুসংহত করতে বাথ পার্টিকে একটি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন এবং আলভী সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিশেষ করে বিশেষ বাহিনী ও সাঁজোয়া বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও গোয়েন্দা পদে নিয়োগ দেন। ১৯৮২ সালে হামায় মুসলিম উগ্রপন্থীরা বিদ্রোহ করলে হাফিজ আল-আসাদের বাহিনী নির্মম দমন অভিযান চালায়। এতে শহরের একটি বড় অংশ ধ্বংস হয় এবং হাজার হাজার সাধারণ মানুষ নিহত হয়।

হাফিজ আল-আসাদের শাসন দমন-পীড়নের জন্য কুখ্যাত হলেও অনেক সিরিয়ান তাঁর শাসনের সময়কালের আপেক্ষিক স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলাকে প্রশংসা করেছিল। দেশটি স্বাধীনতা লাভের পর থেকে প্রায় ক্রমাগত অস্থিরতায় ভুগছিল। হাফিজ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে জরুরি ডিক্রি জারি করে দেশ শাসন করেন। তার শাসন একদিকে যেমন ভয়ের, অন্যদিকে কিছু মানুষের জন্য প্রশংসারও কারণ হয়ে ছিল। ২০০০ সালে তার মৃত্যুর পর সিরিয়া তার ছেলে বাশার আল-আসাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।

সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের পিতার মূর্তি ভেঙে ফেলল জনতাসিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের পিতার মূর্তি ভেঙে ফেলল জনতা
বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বাবার পদাঙ্কই অনুসরণ করেন। তিনি ২০১১ সালে আরব বসন্তের সূচনার আগ পর্যন্ত একপ্রকার নির্বিঘ্নেই দেশ শাসন করেছেন। তবে ২০১১ সালে আরব বসন্ত দমনে তিনি খড়গহস্ত হলে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং তা শিগগিরই গৃহযুদ্ধ রূপ নেয়।

২০১২ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার সংবিধানে উল্লেখ ছিল, বাথ পার্টিই দেশের শাসক দল এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাধ্যমে কেবল বিদ্যমান রাষ্ট্রপতির প্রতি জনগণের সমর্থন নিশ্চিত করা হতো। যদিও বর্তমানে দেশটির সংবিধানে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা বহুদলীয় ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত হওয়া উচিত।

সিরিয়ার পার্লামেন্ট বাথ পার্টি এবং এর মিত্র দল ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ ফ্রন্টের দখলে ছিল এত দিন। তত্ত্বগতভাবে অন্য রাজনৈতিক দল গঠন করা সম্ভব হলেও, বাস্তবে কোনো রাজনৈতিক বিরোধিতা অনুমোদিত নয়। সংবিধান অনুযায়ী, পার্লামেন্টকে আইনসভা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এর প্রকৃত কোনো প্রভাব নেই। প্রকৃত ক্ষমতা কেবল আল-আসাদ পরিবার, দেশের নিরাপত্তা সংস্থা এবং অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত একটি অভিজাত গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত।

সিরিয়ার সংবিধান অনুযায়ী, ২০২৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার কথা ছিল বাশার আল-আসাদের। কিন্তু সম্প্রতি বিদ্রোহীদের দ্রুত অগ্রগতি ও তাঁর নেতৃত্বের সরকারি সামরিক বাহিনীর ব্যর্থতা তাঁর পতনকে ত্বরান্বিত করেছে। ২০১১ সালে যখন সিরিয়ায় গণতন্ত্রের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়, তখন আল-আসাদের শাসনব্যবস্থা বিক্ষোভকারীদের প্রতি নির্মম ও ব্যাপক সহিংসতার মাধ্যমে জবাব দেয়। জাতিসংঘ পরবর্তীতে একে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ২০১২ সাল থেকে সরকার নিয়মিতভাবে হাসপাতাল ও স্কুলসহ বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে এবং বিরোধীদের দমন করতে নিজের জনগণের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে।

সিরিয়ায় যারা গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের দাবিতে সাহসী ভূমিকা পালন করছেন তাদের বাশার আল-আসাদের শাসনামলে চরম মূল্য দিয়েছেন। ২০১১ সাল থেকে প্রায় ১ লাখ মানুষ গুম হয়েছেন, যারা নিজের বা তাদের পরিবারের সদস্যদের আন্দোলনের কারণে বা শুধু বিরোধী পক্ষের অন্তর্ভুক্ত বলে সন্দেহের ভিত্তিতে শিকার হয়েছেন।

কেবল তাই নয়, ১৩ বছর আগে আরব বসন্তের সময় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এখন পর্যন্ত পাঁচ লাখেরও বেশি সিরিয়ান নিহত হয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। এই সংঘর্ষে দেশীয় বিরোধী গোষ্ঠী, চরমপন্থী গোষ্ঠী এবং যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়াসহ আন্তর্জাতিক শক্তি জড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাশার আল-আসাদের মিত্ররা তাঁকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *