পাকিস্তানের মিডিয়া থেকে গায়েব ইমরান খান

পাকিস্তানের মিডিয়া থেকে গায়েব ইমরান খান

আন্তর্জাতিক

মঙ্গলবার রাতে লাইভ টিভি শো চলার সময় পাকিস্তানি উপস্থাপক কাশিফ আব্বাসি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে এক আইনজীবীর দায়ের করা একটি আইনি নোটিশের বিষয়ে কথা বলছিলেন। খবর বিবিসি।

আব্বাসি তার নাম উচ্চারণ করলেন, পরে আবার নিজেকে থামিয়ে দিলেন: ‘তিনি আর্টিকেল ছয় এর অধীনে ইমরান খানের বিরুদ্ধে আবেদন করেছেন… আমি ক্ষমাপ্রার্থী, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আবেদন করেছেন।’

বিবিসি আব্বাসির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দেননি।

গত সপ্তাহে ইমরান খানের নাম বা তার ছবি পাকিস্তানের মিডিয়াতে খুঁজে পেতে বা শুনতে বেশ কসরতই করতে হয়েছে।

এক মাস আগে দুর্নীতির অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করাটা তার এই পতনের পেছনের প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করেছে। গত ৯ই মে যখন খানকে ইসলামাবাদের একটি আদালত প্রাঙ্গন থেকে তুলে নেওয়া হয়, তখন দেশ জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। অনেকেই শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করেছেন, আর অনেকেই ছিলেন সহিংস।

সামরিক স্থাপনা এমনকি লাহোরে অবস্থিত জ্যেষ্ঠ সেনা কমান্ডারের বাসভবনেও হামলা হয়েছিল। পুলিশ সেসময় খানের হাজার হাজার সমর্থককে গ্রেপ্তার করে এবং সামরিক বাহিনী বলেছিল যে, মূল হোতাদের বিচার সামরিক আদালতে করা হবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো অনেক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলেছিলো যে, সেটা আসলে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

৩১শে মে, পাকিস্তানের মিডিয়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা পেমরা পাকিস্তানের সংবাদ চ্যানেলগুলোর জন্য একটি নির্দেশিকা পাঠায়। যেখানে ৯ই মে এর ঘটনার কথা উল্লেখ করে সংবাদ চ্যানেলগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে, ঘৃণা ছড়ায় এমন বক্তব্য যেসব ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ দিয়ে থাকেন তাদের বিষয়ক যেকোন সম্প্রচার থেকে যাতে চ্যানেলগুলো বিরত থাকে।

ওই নির্দেশিকার কোথাও ইমরান খানের নাম উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু বিবিসি বেশ কয়েকটি টিভি স্টেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি যারা জানায়, তাদের চ্যানেলে খুব পরিষ্কার ভাষায় বার্তা পাঠানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইমরান খানের নাম উল্লেখ করা যাবে না, তার ছবি প্রচার করা যাবে না, তার কণ্ঠস্বর শোনানো যাবে না এমনকি চ্যানেলের টিকারেও এরকম কিছু উল্লেখ করা যাবে না। যদি তাকে উল্লেখ করাটা একান্তই দরকার হয় তাহলে খানকে শুধু তার পদবী দিয়ে উল্লেখ করা যাবে, আর সেটি হচ্ছে তার দল পিটিআই এর চেয়ারম্যান।

দুটি সূত্র বিবিসিকে বলেছে যে, তারা তাদের টিভি স্টেশনের মালিকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন যে, চ্যানেলের মালিকদেরকে সামিরক এবং গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকের জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছিল এবং তারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা কী চায়।

‘তাদেরকে বলা হয়েছে, তার নাম রয়েছে এমন কোনো খবর প্রকাশ বা প্রচার করা যাবে না এবং এরপরেও যদি আপনি সেটি করেন তাহলে তার জন্য আপনি নিজেই দায়ী থাকবেন,’ পাকিস্তান টিভিতে কাজ করেন এমন একজন এই তথ্য জানিয়েছেন। মিডিয়ার সব ব্যক্তিই নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন।

বিবিসি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে এখনো উত্তর মেলেনি। পেমরার মহাপরিচালক নির্দেশিকা পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কিন্তু তিনি বলেছেন যে, ইমরান খানের নাম উল্লেখ না করার মতো কোনো নির্দেশনা চ্যানেলগুলোকে দেওয়া হয়নি।

কোনো রাজনীতিবিদকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় ফেলার ঘটনা এটাই প্রথম নয়; ইমরান খান ক্ষমতায় থাকার সময় তার বিরোধী রাজনৈতিক নেতা নওয়াজ শরীফের বক্তব্য প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল।

‘পাকিস্তানে সব সময়ই কোনো না কোনোভাবে সেন্সরশীপ ছিল,’ এক সাংবাদিক বলেন। “আমি প্রায় সময়ই আইএসপিআর(সামরিক বাহিনীর প্রেস শাখা) থেকে ফোনকল পেয়েছি ইমরান খানের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার পরিণতি ভোগ করার বিষয়ে।”

‘তখন আমাদের বিরোধীদলীয় কোনো নেতার সঙ্গে কথা বলতে বেশ বেগ পেতে হতো কারণ তারা কারাগারে ছিল। এখন আমাদের পিটিআইয়ের পক্ষে কথা বলার জন্য কাউকে পেতে বেগ পেতে হয়। খানের শাসনামল এবং এখনকার সময়ের মধ্যে বড় পার্থক্য হচ্ছে এখন বৈধতা পেতে তাদের হাতে ৯ই মে’র উদাহরণ রয়েছে।’

এটি কীভাবে তাদের চ্যানেলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে মিডিয়ায় যারা রয়েছেন তারা বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন।

‘‘এখানকার শীর্ষ চ্যানেলগুলো বলছে: ‘আপনারা একে কীভাবে সামাল দেবেন?’ ভয়ের জায়গাটি হচ্ছে, চ্যানেলগুলো যদি পিটিআই সম্পর্কিত কোনো খবর না দেখায় এবং সরকারি সংবাদ সম্মেলনই বেশি করে প্রচার করে তাহলে তারা শিগগিরই বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।”

‘বিপুল সংখ্যক মানুষ টিভি দেখে কারণ তারা ইমরান খান সম্পর্কে তথ্য জানতে চায়। তিনি যেদিন গ্রেপ্তার হন সেদিন দর্শক সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।’

প্রথমে গ্রেপ্তার এবং পরে ছাড়া পেয়ে পিটিআইয়ের অনেক শীর্ষ নেতা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তার দলটি থেকে পদত্যাগ করছেন। মিডিয়ার ওপর এই কড়াকড়ি আসলে চলতি বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনের আগে ইমরান খানের প্রভাব কমিয়ে আনার অতি সাম্প্রতিক চেষ্টা মাত্র।

তবে এটিকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে তার সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষন করেছেন।

‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তার নাম প্রচারে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ঘুরিয়ে বলা হয়েছে,’ বলেন ফাইসাল ভাওদা যিনি সাবেক পিটিআই নেতা এবং খানের সাবেক ঘণিষ্ঠ সহযোগী। ২০২২ সালের শেষের দিকে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন। ‘আইনগতভাবে দেখতে গেলে পেমরা কোথাও আনুষ্ঠানিকভাবে বলেনি যে এটা তার(ইমরান খান) সম্পর্কে বলা হয়েছে।’

‘যারাই সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত, যেকোনো ধরণের সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত তাদেরকেই সংবাদ মাধ্যমে আনা উচিত নয়, এটাই এই দেশের মৌলিক আইন।’

‘বাস্তবিকপক্ষে এই চিত্র আসলে তার সঙ্গে মিলে যায় কারণ তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সবকিছুর নির্দেশনা দিয়েছেন। সব সাক্ষী বলেছেন যে তারা তার কাছ থেকেই নির্দেশনা পেয়েছেন।’

এই বক্তব্যের বিরোধীতা করেছেন খান। তিনি বলেন সহিংসতা গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল, যদিও তিনি তার বক্তব্যের পক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি।

মিডিয়ায় যারা রয়েছেন এবং যাদের সঙ্গে বিবিসি কথা বলেছে তারা এই বক্তব্যকে হতাশাজনক বলে উল্লেখ করেছেন।

‘এটা অযৌক্তিক,’ একটি টেলিভিশন চ্যানেলে নিয়মিত অনুষ্ঠানে অংশ নেন এমন একজন একথা বলেন। ৯ই মে সম্পর্কিত আলোচনায় তিনি অংশ নিতে পারেন কিন্তু তার ইমরান খানের নাম উচ্চারণ করার অনুমতি নেই।

“আপনি যখন পৌঁছাবেন, তখন তারা আপনাকে বলবে যে, রাজনীতিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের হস্তক্ষেপের বিষয়ে কিছু বলা যাবে না কারণ তাদের শঙ্কা এতে তারা বিপদে পড়তে পারে। এমনকি আপনি যদি তার নামও উচ্চারণ করেন, দেরি হয়ে যাওয়ার কথা বলে তারা আপনার সম্প্রচার বন্ধ করে দেবে। এটা শুধুমাত্র একটা ভয়ের পরিবেশ, এমন মনে হয় যে, আমরা যেন সামরিক আইনের অধীনে বাস করছি।”

রাষ্ট্রযন্ত্র বলতে পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক এবং গোয়েন্দা সংস্থাকেই সংক্ষেপে বোঝানো হয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যে, তারাই(সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থা) সাম্প্রতিক এই কঠোর অবস্থার জন্য দায়ী।

পাকিস্তানের মিডিয়ায় কড়াকড়ি আরোপের নজির থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডার্স এর করা মুক্ত সংবাদমাধ্যমের তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫০ তম।

‘আমি মনে করি, ৯ই মের পর থেকে, মুশাররফের শাসনকাল থেকে আমাদের যে স্থান ছিল তা আমরা হারিয়েছে। আমরা মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা হারিয়েছি,’ একজন সাংবাদিক বিবিসিকে বলেন। ‘গত এক বছরে সামরিক বাহিনী যেভাবে টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রে সমালোচনার শিকার হয়েছে- আমি এর আগে তা কখনো দেখিনি।’

“এখন আমার মনে হয় সেই জায়গাটি ফিরে পেতে আমাদের বছরের পর বছর এমনকি এক দশকের মতো সময় লেগে যেতে পারে।”

‘এটি একটি নজীরবিহীন অবস্থা,’ আরেকজন বলেন। ‘এটা আসলে নিজেরাই নিজেদের ওপর সেন্সরশীপ আরোপ করার মতো, যা সবচেয়ে বেশি খারাপ। এটা নিজের আত্ম-সমালোচনা করার মতো, নিজের দলের আত্ম-সমালোচনা করার মতো। তারা কোন কিছু ভুল করে ফেলতে পারে- এমন ভীতি নিয়ে তারা আমার কাছে আসে, এটা শিরোনাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিংবা কোন অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে হয়ে থাকে। তারা ভয় পায় যে, সেই অতিথি হয়তো ইমরান খানের নাম উচ্চারণ করে ফেলবে অথবা তারা বর্তমানে দলটিতে যা হচ্ছে তা নিয়ে সমবেদনা জানাতে পারে।’

‘এটা সিদ্ধান্তই নেওয়া যায় না যে কাকে অতিথি করা যায়। আমরা আসলেই চাপে আছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *