মরুর বুকে আজ ফুটবে ফুটবলের ফুল

মরুর বুকে আজ ফুটবে ফুটবলের ফুল

খেলাধুলা
চার বছরের প্রতীক্ষা, এক আসর শেষ হলেই পরের আসর কবে আসবে সেই অপেক্ষার শুরু। অবশেষে শেষ হচ্ছে সেই অপেক্ষার। আর মাত্র কয়েক মুহুর্ত পরেই কাতারের মাটিতে বসতে চলছে বিশ্বকাপ ফুটবলের মহাযজ্ঞ। মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম বিশ্বকাপ, মরুর বুকে বল পায়ে ফুটবলের ফুল ফোটাবে ৩২টি দল। বছর, মাস, দিনের হিসেব শেষ। দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’র পর্দা উঠতে আর বাকি কয়েক ঘণ্টা।

৩২ টি দল লড়াইয়ে নামবে আরাধ্য এক সোনালি ট্রফির জন্য। ক্ষণগণনার পালা শেষ হওয়ার পরই মরুর বুকে বেজে উঠবে বিশ্বকাপের বাঁশি। বিশ্বকাপের মহারণে মাঠে  ঝাপিয়ে পড়বে মেসি, রোনালদো, নেইমাররা। তারকাদের মাঠের খেলার সঙ্গে ফুটবলের উন্মাদনায় মেতে উঠবে সমগ্র বিশ্ব।

বিশ্বযজ্ঞের বাঁশি বাজার আগে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে আয়োজক কাতার আর বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা। ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিশ্বকাপে আয়োজনটাও করা হচ্ছে সেভাবে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যই।

ফুটবল বিশ্বকাপ সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩০ সালে । প্রথম বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ে। এরপর থেকে প্রতি চার বছর পরপর অনুষ্ঠিত হচ্ছে ফুটবলের এ বিশ্বযুদ্ধ। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ এবং ১৯৪৬ সালে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়নি।

এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশিবার ফুটবল বিশ্বকাপ শিরোপা জয় করেছে লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। পাঁচবার বিশ্বসেরার ট্রফি নিজেদের ঘরে তুলেছে সেলেসাওরা। এছাড়া চারবার করে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে জার্মানি এবং ইতালি।

আজ থেকে এক যুগ আগে ২০১০ সালে ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের নাম ঘোষনা করেছিল বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা। তৎকালীন ফিফা সভাপতি সেপ ব্ল্যাটার কাতারের নাম ঘোষনা করতে গিয়ে বেশ গর্ববোধ করেই বলেছিলেন প্রথম কোন আরব দেশ হিসেবে কাতারের বিশ্বকাপ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

দুর্নীতির দায়ে শেষ পর্যন্ত ফিফার সভাপতি পদে সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে ক্ষমতা আকড়ে ধরে থাকা ব্ল্যাটার তার পদ হারানোর পাশাপাশি ফুটবল থেকে আজীবন নিষিদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু সেই দুর্নীতিগ্রস্থ ব্ল্যাটারই সুর বদলে কাতার বিশ্বকাপের প্রাক্কালে বলেছেন ঐ সময় আয়োজক হিসেবে কাতারকে বেছে নেওয়া সম্পূর্ণ ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।

বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু নয়, বিশ্বের যেকোন বড় ক্রীড়াযজ্ঞ আয়োজন করতে গেলে বিতর্ক থাকবেই। কাতারও তার উর্ধ্বে নয়। কিন্তু বল মাঠে গড়ানোর আগেই কাতারকে ঘিরে মাঠের বাইরের কিছু  বিষয় নিয়ে যেভাবে সমালোচনা হয়েছে তাতে জল কম ঘোলা হয়নি। বিশেষ করে বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ভেন্যুগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নে স্থানীয় আয়োজকদের প্রায় পুরোটাই অভিবাসী শ্রমিদের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। এই অভিবাসী শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে দাবী করে পশ্চিমা দেশগুলো বলেছে তাদেরকে নায্য পাওনা দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে অংশগ্রহণকারী ইউরোপীয়ান দেশগুলোও এর সাথে সুর মিলিয়ে কথা বলতে শুরু করে।

কিন্তু সব সমালোচনার জবাব হয়তো কখনো কখনো  প্রমাণ করা যায়, কিছু আবার যায়না। কাতারের মতো তেল সমৃদ্ধ একটি ধনী দেশের জন্য বিশ্বকাপ আয়োজনে অর্থের কোন অভাব হয়নি। বিশ্বকাপের স্বত্ব পাবার পর থেকেই পুরো কাতার জুড়ে আটটি নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণকৃত স্টেডিয়ামগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়াম। দোহার ১৫ কিলোমিটার উত্তরে দুই লাখ জনসংখ্যার পরিকল্পিত একটি শহর লুসাইল। সেখানেই গড়ে তোলা হয়েছে ৮০ হাজার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন লুসাইল স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামে আগামী ১৮ ডিসেম্বর টুর্নামেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে।

আজ কাতার বনাম ইকুয়েডরের মধ্যকার উদ্বোধনী ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে আল-খোরের আল-বায়াত স্টেডিয়ামে। এছাড়া অন্যান্য ভেন্যুগুলো হলো- এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম, আহমাদ বিন আলি স্টেডিয়াম, খালিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম, আল থুমামা স্টেডিয়াম, স্টেডিয়াম ৯৭৪ এবং আল-জানুব স্টেডিয়াম।

কাতারের প্রচন্ড গরমের কথা বিবেচনা করে প্রথমবারের মত জুন-জুলাই থেকে সরিয়ে টুর্নামেন্ট নভেম্বর-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একইসঙ্গে টুর্নামেন্টে পরিধি কমিয়ে এনে ২৯ দিনে শেষ করা হচ্ছে। আগামী ১৮ ডিসেম্বর কাতারের জাতীয় দিবসে টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে।

কাতার বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া ৩২টি দেশের মধ্যে ২৪টি দেশই চার বছর আগে রাশিয়ায় খেলেছে। ১৯৩৪ সালে ইতালির পর আয়োজক দেশ হিসেবে একমাত্র কাতার প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে। নেদারল্যান্ড, ইকুয়েডর, ঘানা ও ক্যামেরুন রাশিয়ায় খেলতে ব্যর্থ হওয়ার পর আবারও বিশ্বমঞ্চে ফিরেছে। ১৯৮৬ সালে একমাত্র বিশ্বকাপ খেলা কানাডা ৩৬ বছর পর ফিরেছে বিশ্বজয়ের ময়দানে। অন্যদিকে ইউরোপীয়ান দল হিসেবে ১৯৫৮ সালের পর দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে ওয়েলস। ফিফা র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষ ১০ দলের মধ্যে একমাত্র বাদ পড়েছে ষষ্ঠ স্থানে থাকা ইতালি। এনিয়ে দ্বিতীয়বারের মত বিশ্বকাপে খেলতে ব্যর্থ হলো আজ্জুররিা। সর্বনিম্ন ৬১তম র‍্যাংক থেকে মাঠে নামবে ঘানা।

এবারের বিশ্বকাপ পরিচালনার জন্য ৩৬ জন রেফারি, ৬৯ জন সহকারী রেফারি ও ২৪ জন ভিডিও এ্যাসিসটেন্ট রেফারির নাম ঘোষনা করেছে ফিফা। এই ৩৬জন রেফারির মধ্যে প্রথমবারের মত তিনজন নারী রেফারি ম্যাচ পরিচালনা করবেন বিশ্বকাপের আসরে।

সব বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে সময়মতই মাঠে গড়াচ্ছে কাতার বিশ্বকাপ। ২০ নভেম্বর কাতার বনাম ইকুয়েডরের মধ্যকার উদ্বোধনী ম্যাচের মধ্য দিয়ে শুরু হবে মাসব্যপী ফুটবলের মহাযজ্ঞ। যেখানে পুরো বিশ্বের চোখ থাকবে তাদের প্রিয় দলের দিকে।

৩২টি দেশ আটটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে লড়াই করবে প্রথম পর্বে। আজ থেকে আগামী ২৮ দিন ফুটবল উন্মাদনায় মাতিয়ে রাখবে সারা বিশ্বের ফুটবল প্রেমীদের। ২০ নভেম্বর-২ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে গ্রুপ পর্বের খেলা। প্রতিটি গ্রুপ থেকে শীর্ষ দুই দল নক আউট পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। ৩-৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত শেষ ষোলো এবং ৯-১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত হবে কোয়ার্টার ফাইনালের খেলা। ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর হবে দুটি সেমিফাইনাল। ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে তৃতীয় স্থান নির্ধারনী ম্যাচ। ১৮ ডিসেম্বর হবে বহুল প্রতিক্ষীত ফাইনাল।

সব আয়োজন সম্পন্ন করে মরুভুমির দেশ কাতার এখন সেজেছে ফুটবলের রঙে। স্টেডিয়াম পাড়া থেকে শুরু করে কাতারের বিলাসবহুল শহর বা অলিগলি, সব জায়াগতে কান পাতলেই এখন যেন শোনা যায় ফুটবলের সুর। কাতারে পৌঁছে গেছে বিশ্বকাপের মহারণে নামা ৩২ দলের সবাই। মরুর বুকে এখন ফুটবলের ফুল ফোটানোর দায়িত্বটা মাঠের সৈনিকদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *