নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধিত কিছু ধারা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।

জাতীয় বাংলাদেশ

মাগুরায় আলোচিত শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর ধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধনী আনে। গত ২৫ মার্চ সংশোধিত আইনটির গেজেট প্রকাশ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন আইনে ধর্ষণ মামলার বিচার ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করার বিধান রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল চাইলে মেডিকেল প্রতিবেদন ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রায় দিতে পারবে, যেখানে আগের নিয়মে ডিএনএ পরীক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।

তবে সংশোধিত আইনে সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়নি। কিন্তু ওই ধরনের ঘটনায় শুধুমাত্র পুরুষের জন্য সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা এবং মিথ্যা মামলার দায়ে বাদীর সর্বোচ্চ সাজা দুই বছর নির্ধারণ করায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে।

আইনের ৯খ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি শারীরিক বলপ্রয়োগ ছাড়াই বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৬ বছরের বেশি বয়সী নারীর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করেন এবং তাদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক থাকে, তাহলে পুরুষটি সর্বোচ্চ সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এই আইনের সমালোচনা করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, নারী ও শিশুদের বিশেষ সুরক্ষার লক্ষ্য থাকলেও বর্তমানে নারীরা সবক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন। ফলে শুধুমাত্র নারীদের জন্য বিশেষ আইন করে তাদের পিছিয়ে রাখা হচ্ছে।

নারী অধিকারকর্মী আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক হলে তা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা সঙ্গত নয়। প্রেম বা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর কেবল পুরুষকে শাস্তি দেওয়ার বিধান পক্ষপাতমূলক এবং এতে অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।

পূর্ববর্তী কিছু বিচারিক নজির তুলে ধরে দেখা যায়, ১৯৯৮ সালে হানিফ শেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলায় হাইকোর্ট রায়ে বলে, ১৬ বছরের বেশি বয়সী নারীর সঙ্গে বিয়ের প্রলোভনে যৌনসম্পর্ক ধর্ষণ নয়। ২০০৫ সালের আরেক মামলায় আদালত বলেন, যদি ভিকটিম যৌনকর্মের সময় বাধা না দেন বা চিৎকার না করেন, তবে সম্মতি রয়েছে বলে ধরা হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান মনে করেন, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গঠন প্রতারণার আওতায় পড়ে, যার বিচার দণ্ডবিধিতেই যথেষ্ট। আলাদাভাবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এই ধারা রাখার ফলে এর অপপ্রয়োগের আশঙ্কা বাড়ে।

২০১৭ সালে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলায়ও আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন যে, অভিযোগের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেডিকেল পরীক্ষা করা জরুরি। সেই মামলায় দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার পর ২০২১ সালে সব আসামি খালাস পান।

ভারতের কয়েকটি উচ্চ আদালতের রায়েও দেখা গেছে, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্মতিতে গঠিত শারীরিক সম্পর্ক ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা যায় না। ওড়িশা ও এলাহাবাদ হাইকোর্ট এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একাধিক মামলায় এমন ব্যাখ্যা দিয়েছে।

৯খ ধারা চ্যালেঞ্জ করে করা রিটে আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে কেউ আইনটি অপব্যবহার করতে পারে, যা মামলার সংখ্যা বাড়াতে এবং মামলাবাণিজ্যের সুযোগ তৈরি করতে পারে। অপরাধ যদি হয়ে থাকে, তবে দায় উভয়ের—শুধু পুরুষের ওপর দায় চাপিয়ে আইন করা সংবিধান ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। তিনি মিথ্যা মামলায় দুই বছরের সর্বোচ্চ সাজাকে অপ্রতুল বলেও মন্তব্য করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *