চীন দেশীয় বিমান সংস্থাগুলোকে বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ না কেনার নির্দেশ দিয়েছে

আন্তর্জাতিক

চীনা বিমান সংস্থাগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং থেকে নতুন কোনো উড়োজাহাজের চালান না নিতে নিষেধ করেছে চীন সরকার। মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম ব্লুমবার্গ নিউজের তথ্যের ভিত্তিতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ব্লুমবার্গের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক চীনা পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই বেইজিং এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন সামনে আসার পরপরই বোয়িংয়ের শেয়ারের দাম ০.৫ শতাংশ কমে যায়। উল্লেখ্য, চীন বোয়িংয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় বাজার হলেও সেখানে ইউরোপীয় উড়োজাহাজ নির্মাতা এয়ারবাস ইতিমধ্যে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। ফলে চীনের এই নিষেধাজ্ঞা বোয়িংয়ের বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান আরও দুর্বল করে দিতে পারে।

চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উত্তেজনা এবার সরাসরি প্রভাব ফেলেছে অ্যাভিয়েশন খাতে। উড়োজাহাজ নির্মাতা, পরিবহন সংস্থা এবং যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো একাধিক বিলিয়ন ডলারের চুক্তি নতুন করে পর্যালোচনা করছে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে, যখন মার্কিন সরবরাহকারী হাউমেট অ্যারোস্পেস শুল্ক বহন সংক্রান্ত বিতর্ক উত্থাপন করে।

শুল্ক কাঠামোর এই অনিশ্চয়তা বিমানের সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত করতে পারে। কয়েকটি বিমান সংস্থার শীর্ষ নির্বাহীরা ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, বাড়তি শুল্ক পরিশোধের বদলে তাঁরা বরং উড়োজাহাজ গ্রহণ স্থগিত রাখার দিকেই বেশি আগ্রহী।

চীনের তিন শীর্ষস্থানীয় বিমান সংস্থা—এয়ার চায়না, চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনস এবং চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনস—২০২৫ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে যথাক্রমে ৪৫, ৫৩ ও ৮১টি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, নতুন নির্দেশনায় বেইজিং এসব সংস্থাকে শুধু বিমান নয়, বরং বোয়িংয়ের যন্ত্রাংশসহ বিমান-সম্পর্কিত সব ধরনের পণ্য কেনা থেকেও বিরত থাকতে বলেছে।

অ্যাভিয়েশন খাতের দুইটি নির্ভরযোগ্য সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, চীন থেকে সরাসরি যন্ত্রাংশ আমদানির ওপর কোনো সার্বিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তারা আগে অবগত ছিল না।

এই পদক্ষেপ এমন সময় নেওয়া হয়েছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি চীনা পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত নতুন শুল্ক আরোপ করেছে। এর পাল্টা জবাব হিসেবেই চীন বোয়িংয়ের বিরুদ্ধে এমন সিদ্ধান্ত নিল। ফলে চীনা বিমান সংস্থাগুলোর জন্য বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ কেনা এখন আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর ফলে তারা বিকল্প হিসেবে ইউরোপের এয়ারবাস কিংবা নিজস্ব নির্মাতা সিওএমএসির দিকেই ঝুঁকতে বাধ্য হতে পারে।

তবে বোয়িংয়ের ওপর স্বল্পমেয়াদি প্রভাব সীমিতই থাকবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, চীনে সরবরাহ স্থগিত হলেও সংস্থাটি সেসব উড়োজাহাজ অন্যান্য আন্তর্জাতিক গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করতে পারবে। পাশাপাশি, চীনের বিশাল চাহিদা এককভাবে এয়ারবাসের পক্ষে মেটানোও সম্ভব নয়।

ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, বোয়িংয়ের বিমান কেনার কারণে যে চীনা এয়ারলাইন্সগুলো উচ্চ ব্যয়ের মুখে পড়েছে, তাদের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা বিবেচনা করছে চীনা সরকার। উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩৫০ জন নিহত হওয়ার পর চীনই সর্বপ্রথম বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স সিরিজের বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সে সময় চীন বেশিরভাগ অর্ডার ও সরবরাহ স্থগিত করেছিল।

সাম্প্রতিক এই নিষেধাজ্ঞা বোয়িংয়ের জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দিয়েছে। গত বছর বোয়িং মারাত্মক সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। বিশেষ করে, এক ম্যাক্স ৯ জেট বিমানের মাঝ আকাশে দরজা খুলে যাওয়ার ঘটনায় কোম্পানির ওপর বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন ওঠে। এতে তাদের শেয়ারের দাম এক-তৃতীয়াংশের বেশি কমে যায়।

বিশ্বের দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান পাল্টাপাল্টি শুল্কের কারণে ২০২৪ সালে প্রায় ৬৫০ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য অনিশ্চয়তায় পড়েছে। এই বাণিজ্য উত্তেজনা কীভাবে আরও বিস্তৃত খাতে প্রভাব ফেলবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *