গ্যাস সংকটে থেমে গেছে বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের রপ্তানির অগ্রযাত্রা।

দেশজুড়ে বাংলাদেশ

**গ্যাস সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিজয়পুরের মৃৎশিল্প কেন্দ্রের রপ্তানি সম্ভাবনা**

দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও কুমিল্লার বিজয়পুর মৃৎশিল্প কেন্দ্রের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সম্প্রতি এখান থেকে তৈরি মাটির পাত্র সরাসরি রপ্তানি হয়েছে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়। তবে আরও বড় পরিসরে রপ্তানির সুযোগ থাকলেও, গ্যাস সংকটের কারণে কার্যক্রম থেমে গেছে। প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ জনবল থাকা সত্ত্বেও টিকে থাকতে লড়ছে এ শিল্প কেন্দ্রটি।

**গ্যাস নয়, চলছে লাকড়িতে**

রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির অধীনে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, শিল্পের জন্য বরাদ্দ গ্যাস বেআইনিভাবে আবাসিক সংযোগে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে গ্যাসের চাপ কম থাকায় ফার্নেসে পর্যাপ্ত তাপ উৎপন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না, যা রপ্তানিযোগ্য মানের পণ্য তৈরির জন্য জরুরি।

গ্যাস সঙ্কটের কারণে ২০০৯ সালে স্থাপিত ফার্নেস চুল্লি বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন আগে। বর্তমানে বিকল্প হিসেবে লাকড়ির চুল্লিতে পণ্য পোড়ানো হচ্ছে। এতে সময় বেশি লাগে, তাপও কম থাকে, ফলে পণ্যের মানেও ঘাটতি দেখা দেয়। পাশাপাশি বাড়তি লাকড়ির খরচে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে, যা পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক দাম ধরে রাখতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

**রপ্তানির সম্ভাবনা ও ব্যর্থতা**

সমিতির সভাপতি দীপক চন্দ্র পাল জানান, স্থানীয় বাজারে প্রতি মাসে প্রায় ৮ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়। তবে বিদেশে রপ্তানির চাহিদা থাকলে বিক্রির পরিমাণ আরও বাড়ে। সর্বশেষ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে দইয়ের পাতিল ও মটকার চালান গেছে ১০ লাখ টাকার।

রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মান ধরে রাখতে গ্যাস নির্ভর ফার্নেসই সবচেয়ে উপযোগী, কিন্তু সেটি এখন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

**নারীরাই এই শিল্পের চালিকাশক্তি**

বিজয়পুর মৃৎশিল্প কেন্দ্রে কর্মরত ৫০ জনের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই নারী। কাঁচা মাটি প্রস্তুত করা, পাত্র তৈরির ছাঁচে বসানো, শুকানো, পোড়ানো, প্যাকেজিংসহ প্রায় প্রতিটি ধাপেই নারীরা সরাসরি যুক্ত। তাদের অনেকেই এই পেশায় এসেছেন বংশপরম্পরায়, কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে।

একজন নারী কর্মী পার্বতী রানী পাল জানান, ৯ বছর আগে ৩ হাজার টাকা বেতনে কাজ শুরু করলেও বর্তমানে তার বেতন ৯ হাজার ৩শ টাকা। অন্যদিকে রাখী পাল জানান, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে শেখা এই কাজ এখন তার পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

**দীর্ঘদিনের ইতিহাস, আজ চ্যালেঞ্জে ভরা বাস্তবতা**

১৯৬১ সালে ড. আখতার হামিদ খানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমিতি এখন টিকে আছে তারই স্থাপিত ভিত্তির ওপর। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়নও হয়েছে। তবে ২০১৯ সাল থেকে গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদনে ধস নেমেছে।

সমিতির হিসাবরক্ষক রাজেশ চক্রবর্তী জানান, উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিদেশি চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বাখরাবাদ গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানায়, সংযোগ সঙ্কট সমাধানে মৃৎশিল্প কেন্দ্র চাইলে নতুনভাবে একটি পৃথক সংযোগের জন্য আবেদন করতে পারে, যা ভালো চাপযুক্ত লাইনের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।

**ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন কার্যকর সমাধান**

শিল্পকেন্দ্রের কর্মীরা এবং সমিতির নেতৃবৃন্দ সবাই মনে করেন, গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে রপ্তানি সম্ভাবনা অনেকটাই বাস্তবে পরিণত হতে পারে। শুধু স্থানীয় বাজার নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও মাটির এই শিল্প পা রাখতে পারবে আরও জোরালোভাবে। তা না হলে, দক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে পারে এই ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের গৌরবময় ইতিহাসও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *