দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে গতিশীল রাখতে আসন্ন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ১৫৪টি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এসব প্রকল্পের মেয়াদ দুই থেকে সাত বছর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে, আর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় চার লাখ কোটি টাকা। এর বড় অংশই আসবে বিদেশি ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, এসব প্রকল্প ১০টি খাতে ভাগ করা হয়েছে, যেখানে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৬৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ১২৯টি প্রকল্পে ৭৮ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা অর্থায়ন করবে, আর অবশিষ্ট প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা আসবে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, অতীতে প্রকল্প বরাদ্দের নামে ঋণ গ্রহণের অপব্যবহার হয়েছে এবং বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনাও ঘটেছে। তবে এবার প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করে শুধুমাত্র যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেশের অর্থনীতি ও জনকল্যাণের স্বার্থে এসব প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন, তাই এগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
নতুন এডিপিতে সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি স্বাস্থ্য খাতে নেওয়া হয়েছে। ‘৫ম জনস্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি’ নামের এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এটি পূর্ববর্তী সরকারের সময় অনুমোদিত হলেও সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার একে এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, পুল ফান্ড ও এমআইআইবি এর মূল অর্থায়ন করছে। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদি এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, রোগ নিয়ন্ত্রণ, টিকা ও পুষ্টি কর্মসূচিসহ ৩০টিরও বেশি উদ্যোগ বাস্তবায়িত হবে।
এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হলো ‘ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট (লাইন-৫) রুট সাউদার্ন’। বিগত সরকার এটি হাতে নিয়েছিল, যার ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫২ হাজার কোটি টাকা। একনেক সভার অনুমোদনের পর প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই করে ব্যয় ৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৪৭ হাজার ৭২১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি ২০২৭ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে জাইকার অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বৈদেশিক ঋণের চাপ ইতিমধ্যে বেড়ে গেছে, ফলে নতুন করে ১৫৪টি প্রকল্পের জন্য আরও ঋণ নেওয়া হলে অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। কারণ, দাতা সংস্থাগুলো এখন স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিয়ে বেশি সুদ নিচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কম দিচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরীর মতে, পূর্ববর্তী সরকারের নেওয়া কিছু বড় অবকাঠামো প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায়নি, ফলে সরকারকে এসব প্রকল্পের ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে। নতুন প্রকল্প গ্রহণের আগে এসব বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন, না হলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হতে পারে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়ের প্রকল্পটি হলো ‘বে-টার্মিনালের নৌ-চলাচল অবকাঠামো এবং পশ্চাদ্ভূমি সংযোগ সুবিধাদি উন্নয়ন প্রকল্প’। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ১৩২ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা ২০২৭ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
অন্যদিকে, ‘হাটিকুমরুল-বনপাড়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের বনপাড়া-কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ অংশ’ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা, যেখানে এআইআইবি ঋণ সহায়তা প্রদান করবে। প্রকল্পটি ২০৩১ সালে শেষ হওয়ার কথা।
পঞ্চম সর্বোচ্চ ব্যয়ের প্রকল্পটি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের, যার নাম ‘ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট অব সিভিল সার্ভিস প্রকল্প’। ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পটি ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত চলবে এবং এর অর্থায়ন করবে জাইকা।
এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পগুলোর বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার চলমান প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করেছে এবং অপ্রয়োজনীয় বা অযৌক্তিক প্রকল্প বাতিল করেছে। এতে ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত হয়েছে।
সরকারের নতুন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেও গুরুত্বপূর্ণ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এডিপির প্রকল্পগুলো ১০টি খাতে ভাগ করা হয়েছে, যার মধ্যে গৃহায়ণ ও কমিউনিটি সুবিধাবলি খাতে সর্বোচ্চ ২৮টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এছাড়া কৃষিতে ১৫টি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ২৪টি, পরিবহন ও যোগাযোগে ১৮টি, শিক্ষায় ১৬টি, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ১০টি, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে ৯টি, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় ৬টি, তথ্যপ্রযুক্তিতে ৫টি, ধর্ম ও বিনোদনে ৪টি, স্বাস্থ্য ও জনশৃঙ্খলায় ৩টি করে এবং সামাজিক সুরক্ষা ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ২টি করে মোট ৪টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার মনে করেন, চলমান স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ খাতের কিছু প্রকল্পকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা সঠিক সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, বর্তমানে মেট্রোরেল চালু রয়েছে, এবং রাজধানীতে এর নতুন অংশ যুক্ত হলে তা জনবান্ধব হবে এবং অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।