জেলার উন্নয়ন জেলা পরিষদের অধীনে রাখার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।

দেশজুড়ে বাংলাদেশ

জেলার উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর নিয়ন্ত্রণ জেলা পরিষদের হাতে রাখার সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।

কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে, জেলা পরিষদের নেতৃত্বে থাকবেন চেয়ারম্যান, আর যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন।

এছাড়া, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কে জাতীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে পৃথকভাবে পরিচালনা করা এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন।

সরকার পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দ্বিতীয় ধাপে গঠিত ‘স্থানীয় সরকার সংস্কার’ কমিশনের প্রাথমিক সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন শনিবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে প্রকাশ করা হয়।

### সংস্কার কমিশনের সুপারিশসমূহ

**স্থানীয় সরকার সংগঠন ও আইন:**
কমিশন স্থানীয় সরকার কাঠামোর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। দেশে বর্তমানে প্রচলিত তিন স্তরের গ্রামীণ স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ) এবং শহরাঞ্চলের স্থানীয় সরকার (পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন) আইন ও সাংগঠনিক কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে।

জেলা পরিষদের কার্যপরিধি ও কাঠামোয় মৌলিক পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া সারাদেশে স্থানীয় সরকারের পাঁচটি পৃথক আইন থাকায় ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ কাঠামোর মধ্যে অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি হয়েছে বলে কমিশন জানিয়েছে। তাই তিনটি আলাদা আইনের পরিবর্তে একটিকে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের জন্য এবং অপরটিকে নগর স্থানীয় সরকারের জন্য অভিন্ন আইনের আওতায় আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

**নারী প্রতিনিধিত্ব:**
কমিশন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য প্রচলিত সংরক্ষিত নারী আসন পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করেছে। নতুন কাঠামো অনুযায়ী, পরিষদ ও কাউন্সিলের মোট ওয়ার্ডের এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিদের জন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সংরক্ষিত রাখা হবে।

স্থানীয় পর্যায়ে বিচার ব্যবস্থা:
আগামী দুই বছরের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত দেশের সকল উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপনের সুপারিশ করেছে কমিশন।

প্রতিটি উপজেলায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন সিনিয়র সহকারী জজ ও একটি পৃথক কার্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। গ্রাম আদালত বিলুপ্ত করে ওয়ার্ড পর্যায়ে সালিশ ব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে।

স্থানীয় সরকারের অর্থায়ন:
ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরনকে কর রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

জেলা ও উপজেলা পরিষদ নিজস্ব সম্পত্তির আয়, বিভিন্ন ফি এবং সরকারি অনুদানের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।

বর্তমান অর্থায়ন ব্যবস্থার অস্বচ্ছতা ও তদবির নির্ভর দুর্নীতি দূর করতে কর রাজস্ব, সরকারি অনুদান ও প্রকল্পভিত্তিক অর্থায়ন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

স্থায়ী স্থানীয় সরকার কমিশন:
কমিশন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক মর্যাদাসম্পন্ন স্থায়ী স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে।

এই কমিশন স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত আইন, বিধি ও নীতিমালা তৈরিতে সরকারের সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

স্থানীয় সরকার সার্ভিস কাঠামো:
স্থানীয় সরকার পর্যায়ে জনবল ব্যবস্থাপনায় দুটি পৃথক কাঠামো গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রেষণে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যক্রম ও সরকারি সম্পদ স্থানীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হবে। তবে তাদের নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় নিয়ম অনুযায়ী হবে।

সংস্কার প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক সংলাপ

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে।

অক্টোবরে প্রথম ধাপে রাষ্ট্রের ছয়টি খাতে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করা হয়।

এরপর ১৮ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী ও স্থানীয় সরকার সংস্কারের জন্য আরও পাঁচটি কমিশন গঠন করা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সাত সদস্যের স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন ১৫টি ক্ষেত্রে কাজ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে, তবে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে আরও সময় প্রয়োজন বলে জানিয়েছে।

সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন ও রাজনৈতিক সংলাপ:
দ্বিতীয় ধাপে গঠিত পাঁচটি সংস্কার কমিশনের মধ্যে ‘স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন’ প্রথম প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

এর আগে, সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া হয়।

৮ ফেব্রুয়ারি ছয়টি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে সাত সদস্যের ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করা হয়।

এই কমিশন আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন সংশ্লিষ্ট সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে।

এরই মধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এক দফা সংলাপ করেছেন মুহাম্মদ ইউনূস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *