একটি নজিরবিহীন নির্বাচনী বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ২০২৪ সাল। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বছরজুড়ে। এসব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী মানুষ যেসব বড় হুমকির মুখোমুখি হতে পারে তার মধ্যে অন্যতম বিবেচিত হয়েছে ‘মিথ্যা তথ্য’। পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, নির্বাচনের সময়গুলো অনলাইনে মিথ্যা বা ভুয়া তথ্য ছড়ানোর একটি ‘মৌসুম’ হয়ে ওঠে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) গ্লোবাল রিস্ক ২০২৪ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটিতে বিশ্লেষকদের মতামতের ভিত্তিতে এই মিথ্যা বা ভুয়া তথ্য ছড়ানোকে বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে মিথ্যা তথ্য ও ভুয়া তথ্য ছড়ানোর ঝুঁকির দিক থেকে ভারত শীর্ষে রয়েছে।
বিভিন্ন দেশের মানুষের অনলাইনে উপস্থিতি ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে ২০২৪ ও ২০২৫ দুই বছরে ভুল তথ্য এবং মিথ্যা তথ্য কতটা গুরুতর সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। ৩৪টি অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, ভূরাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রযুক্তিগত ঝুঁকির মধ্যে র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ‘মিথ্যা তথ্য’ (ডিসইনফরমেশন) হলো এমন তথ্য, যেখানে এই তথ্যের প্রচারকারী ইচ্ছাকৃতভাবে শ্রোতাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে, ‘ভুল তথ্য’ (মিস ইনফরমেশন) হলো এমন তথ্য যা সরল বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রচারিত হয়। কিন্তু এটিও সমানভাবে ক্ষতিকর হতে পারে—যেমন, কখনো কখনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে।
তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মিথ্যা তথ্য ও ভুল তথ্যের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি রয়েছে ভারতে। বিশ্লেষকদের মতে, দেশটির ক্ষেত্রে এটি অন্যান্য বড় ঝুঁকিগুলোর (যেমন: সংক্রামক রোগ, অবৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রম, বৈষম্য এবং বেকারত্ব) তুলনায় সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ১৪০ কোটি জনসংখ্যার এই দক্ষিণ এশীয় দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে।
ভারতে ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভুয়া খবর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্বাধীন গণমাধ্যম ভাইস একটি প্রতিবেদনে দেখায়, রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে উত্তেজনাপূর্ণ বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল। এ ধরনের প্রচার অনলাইনে ক্ষোভ ও ঘৃণা বাস্তবিক সহিংসতায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে, কোভিড–১৯ মহামারির সময়ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ভারতে ভুল তথ্য ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছিল।
উপাত্ত বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, ভুল তথ্য ও মিথ্যা তথ্যের প্রভাবের উচ্চ ঝুঁকির মুখোমুখি অন্য দেশগুলো হলো—এল সালভাদর, সৌদি আরব, পাকিস্তান, রোমানিয়া, আয়ারল্যান্ড, চেকিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, সিয়েরা লিওন, ফ্রান্স এবং ফিনল্যান্ড। এই দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই ঝুঁকিকে ৩৪টি ঝুঁকির মধ্যে ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ স্থানে রাখা হয়েছে। যুক্তরাজ্যে ভুল তথ্য ও মিথ্যা তথ্য অন্যান্য ঝুঁকির তালিকায় ১১ তম স্থানে রয়েছে।
ডব্লিউইএফ–এর বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনী প্রক্রিয়াগুলোতে ভুল তথ্য ও মিথ্যা তথ্যের ছড়াছড়ি নবনির্বাচিত সরকারের প্রকৃত ও ধারণাগত বৈধতাকে গুরুতরভাবে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে। এতে করে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা এবং সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এই প্রতিবেদন ১ হাজার ৪৯০ জন বিশ্লেষকের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন—শিক্ষাবিদ ও গবেষক, ব্যবসা, সরকার, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি। সমীক্ষাটি ২০২৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পরিচালিত হয়েছিল।