তৃতীয় শ্রেণির চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন এক দশক আগে। এই পদে চাকরি করে আক্ষরিক অর্থে ‘পাহাড়সম’ সম্পদ হয়েছে বান্দরবানের লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নাজমুল আলমের। তদবির-বাণিজ্য, মিয়ানমার থেকে চোরাকারবারের মাধ্যমে তৈরি করেছেন আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি, পাহাড়ের জায়গা কিনে করেছেন রিসোর্ট, বাগান। আছে একাধিক গাড়ি, ট্রাক। বেতনের সঙ্গে সম্পদের সামঞ্জস্য না থাকায় এখন এলাকায় তাঁর নাম মানুষের মুখে মুখে।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে লামা উপজেলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর (মুদ্রাক্ষরিক) হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন নাজমুল আলম। এরপর থেকে তিনি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাঁর বাবা ওসমান গনি দুলাল উপজেলা ভূমি অফিসের চেইনম্যান। বাবা-ছেলের যোগসাজশে অবৈধ পন্থায় গড়ে তুলেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০-২৫ বছর আগে চাকরির সূত্রে নোয়াখালী থেকে বান্দরবানের লামায় আসেন নাজমুলের বাবা। এরপর লামা পৌরসভার বড় নূনারবিল ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বাড়ির জন্য ৫ শতক জায়গা কেনেন। ২০১৪ সালে নাজমুল চাকরিতে যোগদানের পর রাতারাতি বদলে যেতে থাকে সবকিছু। নাজমুল আলমের ছোট ভাই লামা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। বড় ভাইয়ের সঙ্গে যোগসাজশে অফিসের সবাইকে ম্যানেজ করে ঠিকাদারি কাজ করতেন বলে অভিযোগ আছে।
লামার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সিলেটিপাড়ার বাসিন্দা আলী আহম্মেদ বলেন, ‘নাজমুলরা গত কয়েক বছরে অবৈধভাবে মিয়ানমার থেকে আসা গরু ব্যবসা থেকে টাকাওয়ালা হয়ে গেছেন। ওখান থেকেই টাকা কামাইছেন। তাঁরা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। জিরো থেকে হিরো হয়ে গেছেন।’
নাজমুলের যত সম্পদ
লামার ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার মিরিংঞ্জা মুরুং পাড়ার পাশে নাজমুলের আম ও সেগুনবাগান রয়েছে ৫ একর। লামায় কলেজের সামনে মার্কেটসহ ৫ শতক জায়গা, লামা থানার সামনে টাইলসের দোকান রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া একটি এক্স নোহা গাড়ি, একটি চান্দের গাড়ি, দুটি ট্রাক কিনেছেন তিনি।
নাজমুলের একটি ট্রাকের চালক শহিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গাড়িটি নাজমুলের। এটি ব্যতীত আর অন্য কোনো গাড়ি আছে কি না, তা আমি জানি না।’
এদিকে লামার সাবেক বিলছড়ির ৬ নম্বর ওয়ার্ডে সিলেটিপাড়া এলাকায় ৬ একর পাহাড়জুড়ে সেগুনবাগানসহ আবাদি জমি রয়েছে নাজমুলের নামে। এর বাজারমূল্য কোটি টাকা। এত টাকা খরচ করে তৈরি করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। তিনি লামা বাজারের মধ্যে সানা ফ্যাব্রিকস ও শাহ্ জব্বারিয়া ক্লথ স্টোর নামে দুটি কাপড়ের দোকানের অংশীদার। লামার মিরিঞ্জা পাহাড় এলাকায় ৩ একর জায়গাজুড়ে মারাইংছা হিল এবং ১০ একর জায়গাজুড়ে রিভার ভিউ নামের দুটি রিসোর্টের অংশীদার তিনি। মারাইংছা হিলের সঙ্গে ব্যক্তিগত আরও ৫ একর জায়গা কিনেছেন নাজমুল।
লামার ইয়াংছা বাজার এলাকার বাসিন্দা মো. ইলিয়াছ বলেন, ‘কয়েক বছর আগে ইয়াংছা ক্যাম্পের ফরেস্ট বিভাগের পাশে ২০ শতক জায়গা ১০ লাখ টাকায় আমার কাছ থেকে কেনেন তিনি।’
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সঙ্গে সখ্য ছিল নাজমুলের। সাবেক এই মন্ত্রী বান্দরবানের বাসিন্দা না হওয়া সত্ত্বেও পার্বত্য আইন অমান্য করে ৩০৩ নম্বর ডলুছড়ি মৌজায় তৃতীয় শ্রেণির ২৫ একর জায়গা কিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। অবৈধ এই কাজে সহায়তা করে সাবেক মন্ত্রীর কাছ থেকে বিপুল অর্থ নেন নাজমুল। এ ছাড়া নাজমুল আলম সরকারি দপ্তরের পদবি ব্যবহার করে লামা ছাগলখাইয়্যা এলাকায় বালুর পয়েন্টের অংশীদার।
লামার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা আবু তাহের বলেন, ‘নাজমুল ২০-২৫ কোটি টাকার মালিক। সে ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছে। সে যদি অস্বীকার করে, তাহলে আমি সরাসরি চ্যালেঞ্জ করব।’
বড় নূনারবিল চহ্লাচিং মার্মা (৬৮) বলেন, ‘শূন্য থেকে তাঁরা আজ অনেক টাকার মালিক। বাপ-দাদাদের কোনো সহায়-সম্পত্তি ছিল না। ২০ বছরে তাঁর বাবা বাড়ির জায়গা কিনেছেন। এত সম্পদ কীভাবে হলো, তদন্ত হওয়া দরকার।’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নাজমুল আলম। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মারাংছা হিল রিসোর্ট ব্যতীত আর কোনো সম্পদ আমার নয়। এসব সম্পদ বাবা-মা ও ভাইয়ের নামে। আমার নামে কোনো সম্পদ নেই। আমার ভাই উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।’
লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামরুল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নাজমুল অনেক সম্পদের মালিক কি না জানি না। লিখিত কোনো অভিযোগ পেলে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।’