ডিমের পর খামারে বাচ্চা সরবরাহে সিন্ডিকেট, বিপাকে খামারিরা

জাতীয়

দেশের পোলট্রি খাতে সংকট যেন লেগেই আছে। ডিম ও মুরগির দামে চলমান অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে সরকারনির্ধারিত মূল্য কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়ার পর এবার নতুন করে দেখা দিয়েছে এক দিনের মুরগির বাচ্চা সরবরাহের সংকট। প্রান্তিক খামারিদের অভিযোগ, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো পরিকল্পিতভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাচ্চার সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে, যা খাতটিতে আরও চাপ বাড়িয়েছে।

এতে প্যারেন্ট স্টক (পিএস) থেকে উৎপাদিত এক দিনের মুরগির বাচ্চার দাম মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে খামারিরা বলছেন, এর ফলে তাঁদের উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে, যা ন্যায্য মুনাফা অর্জনের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করছে।

এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিরা। বাড়তি দামে বাচ্চা কিনে উৎপাদন চালানো তাঁদের জন্য ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠছে। অভিযোগ রয়েছে, সরকার ডিম ও মুরগির নির্ধারিত মূল্য কার্যকর করায় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এক দিনের বাচ্চার দাম বাড়িয়ে নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এর ফলে বাচ্চার সরবরাহ কমে যাওয়ায় প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রভাব শুধু খামারিদের অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না; দেশের পোলট্রি খাতও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হচ্ছে। এই অবস্থায় বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং ক্ষুদ্র খামারিদের টিকিয়ে রাখতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

করপোরেট চক্রের নিয়ন্ত্রণ

দেশের পোলট্রি খাতের জিপি স্টক সরবরাহে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্য রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান একদিকে পোলট্রি বাচ্চার উৎপাদন এবং সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে, অন্যদিকে বাজারের সামগ্রিক স্থিতিশীলতায়ও বড় প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) এবং খামারিরা অভিযোগ করেছেন, প্যারাগন পোলট্রি, সিপি বাংলাদেশ, প্রভিটা ফিড, নাহার অ্যাগ্রো, নারিশ ফার্মস ও আফতাব হ্যাচারির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে বাচ্চার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এর ফলে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে বাচ্চার দাম ছিল ৩০-৩৫ টাকা, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ১১০ টাকায়।

বিপিএর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ মুরগির বাচ্চা বিক্রি হয়। সেই হিসাবে বাচ্চাপ্রতি ৩০ টাকা অতিরিক্ত নেওয়া হলে ৬০ দিনে করপোরেট চক্র খামারিদের কাছ থেকে প্রায় ৫৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

খামারি ও ডিলারদের অসন্তোষ

চট্টগ্রামের খামারি রাইসুল কবির জানান, দেড় মাস ধরে লেয়ারের বাচ্চার অর্ডার দিয়ে কোনো সাড়া পাননি। ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির বাচ্চা দ্বিগুণ দামে কিনতে গিয়ে তাঁর খামার পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে।

কাজী ফার্মস গ্রুপের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ব্রয়লার বাচ্চা ৫৫ টাকা এবং লেয়ার বাচ্চা ৬৭ টাকায় ডিলারদের কাছে বিক্রি করছি। তবে বাচ্চার সংকটের কারণে দাম বেড়েছে।’

প্রভিটা ফিডের ডিলার মো. নিজাম বলেন, ‘আগে যে বাচ্চা ২৮-৩০ টাকায় কিনতাম, এখন তা ৫৭-৫৯ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এই দ্বিগুণ মূল্য আমাদের বিপাকে ফেলছে।’

নাহার অ্যাগ্রোর ডিলার মিজানুর রহমান বলেন, ‘লেয়ার মুরগির বাচ্চা এখন ১১০ টাকায় বিক্রি করছি। একইভাবে সোনালি মুরগির বাচ্চা, যা আগে ১৮-২০ টাকায় পাওয়া যেত, তা এখন কিনতে হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকায়। আমাদের জন্য এটি একটি অভাবনীয় চাপ।’

ফেনীর খামারি মারুফ আদনান অভিযোগ করেন, ‘২৫ হাজার লেয়ারের বাচ্চার প্রয়োজন, কিন্তু ৮৪ টাকায়ও পুরো চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ছোট খামারিদের আরও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, যা তাঁদের জন্য টিকে থাকা কঠিন করে তুলেছে।’

ডিলার আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘কোম্পানিগুলো আমাদের চাহিদা অনুযায়ী বাচ্চা সরবরাহ করছে না; বরং কালোবাজারে ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি করছে। এটি বাজারকে অস্থিতিশীল এবং খাতটি ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’

এই সংকট প্রান্তিক খামারিদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন।

ফিডের দামও বেড়েছে

মুরগির বাচ্চার পাশাপাশি ফিডের দামও বেড়ে গেছে। এতে খামারিদের উৎপাদন খরচ লাফিয়ে বাড়ছে। এই অবস্থায় তাঁরা মুরগি ও ডিমের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর।

সিন্ডিকেট ভাঙার পরামর্শ ক্যাবের

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘পোলট্রি খাত করপোরেট চক্রের হাতে বন্দী। তারা মুরগির বাচ্চা, ফিড, ওষুধ ও ডিম বিক্রি করে। ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে খাতটিকে চরম অস্থিরতায় ফেলা হচ্ছে।

নাজের হোসেন আরও বলেন, ‘সরকার ডিম ও মুরগির দাম নির্ধারণ করলেও বাচ্চা ও ফিডের ক্ষেত্রে কোনো নির্দেশনা দেয়নি। এই সুযোগে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা লুটছে। এই অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে সরকারকে দ্রুত বাচ্চা, ফিড এবং ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিতে হবে।’

ভবিষ্যৎ শঙ্কা ও করণীয়

প্রান্তিক খামারিরা ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হলে বাজার পুরোপুরি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে, যা ভোক্তাদের ওপর বাড়তি মূল্য চাপাবে। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার সতর্ক করে বলেন, ‘সরকার যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, পোলট্রি খাত গভীর সংকটের মুখে পড়বে।’ এই সংকট মোকাবিলায় তিনি কয়েকটি করণীয় প্রস্তাব করেন, সেগুলো হলো: বাচ্চা ও ফিডের সুনির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ এবং বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা; কৃত্রিম সংকট রোধে নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ এবং সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ; বিশেষ কমিটি গঠন, যা চাহিদা-সরবরাহ পর্যবেক্ষণ করে সংকট মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে; প্রান্তিক খামারিদের আর্থিক সহায়তা, সহজ শর্তে ঋণ এবং প্রণোদনার ব্যবস্থা। সুমন হাওলাদারের মতে, এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা গেলে পোলট্রি খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং ভোক্তা ও খামারিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *