খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রা চূড়ান্ত

জাতীয়

শারীরিক অবস্থা ঠিক থাকলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ৮ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার্থে বিদেশে নেওয়া হবে। তাঁর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিদেশ যাত্রার বিষয়টি ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রথমে তাঁকে নেওয়া হবে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। সেখান থেকে পরবর্তীতে চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র কিংবা জার্মানির কোনো মাল্টি ডিসিপ্লিনারি হেলথ সেন্টারে নেওয়া হতে পারে লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য। মেডিকেল বোর্ডের সাতজন চিকিৎসক, নার্স ও তিনজন সহকারীসহ ১৬ জন তাঁর সঙ্গে যাবেন। সবার ভিসা প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ৮ নভেম্বর শুক্রবার তাঁকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হবে। এখন শুধু ‘লং ডিসটেন্স স্পেশালাইজড এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের’ অপেক্ষায়। কারণ, এত দীর্ঘ সময়ের জার্নিতে বিশেষায়িত এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া তাঁকে কিছুতেই বিদেশে নেওয়া সম্ভব নয়। ফলে ‘লং ডিসটেন্স স্পেশালাইজড এয়ার অ্যাম্বুলেন্স’ অনিবার্য। আর সেটি অত্যন্ত দুর্লভ। সারাবিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি দেশেই রয়েছে এ ধরনের স্পেশালাইজড এয়ার অ্যাম্বুলেন্স। তবে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন- সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই স্পেশালাইজড অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসক ও দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনও জানিয়েছেন, ৮ নভেম্বর লন্ডন যাবেন বেগম খালেদা জিয়া। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁর ও যাত্রা-সঙ্গীদের ভিসা প্রাপ্তিতে সহযোগিতা প্রদানসহ বিষয়টি তদারকি করছে। তবে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত তাঁর শারীরিক অবস্থা এবং স্পেশালাইজড এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কনফার্মেশনের ওপরই নির্ভর করছে তাঁর উন্নত চিকিৎসার্থে বিদেশ যাত্রা। সেক্ষেত্রে যাত্রার তারিখ দু-এক দিন এদিক সেদিকও হতে পারে।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সাত (চিকিৎসক) সদস্যেরও যাওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া তাঁর সঙ্গে পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান ও গৃহপরিচালিকা ফাতেমা ও রূপার যাওয়ার কথা রয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ম্যাডামের শারীরিক সুস্থতার ওপর নির্ভর করে অতিদ্রুত তাঁকে বিদেশে ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি অ্যাডভান্স হেলথ’ সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন।

তারই অংশ হিসেবে আমাদের ‘লং ডিসটেন্স স্পেশালাইজড এয়ার অ্যাম্বুলেন্স’ ভাড়া করার কাজও শেষের দিকে। প্রথমে ম্যাডামকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে স্টে-ওভারের পরে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি মেডিকেল সেন্টার যে দেশে আছে, সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। আমরা আশা করছি, সব কাজ সম্পন্ন করেই অতিদ্রুত ম্যাডামকে বিদেশে নিয়ে যেতে পারব।

বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ডা. জাহিদ বলেন, ম্যাডাম গুলশানের বাসায় আগের মতোই মেডিকেল বোর্ডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি। তাঁর শারীরিক অবস্থা এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাবেন সে বিষয়ে এরই মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও তাঁর কার্যালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ম্যাডামের সঙ্গে চিকিৎসক-নার্সসহ আত্মীয়স্বজন যাঁরা যাবেন, তাঁদের বিষয়ে জানানো হয়েছে। চিকিৎসকদের মধ্যে খালেদা জিয়ার সঙ্গে লন্ডন যাবেন- মেডিকেল বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, প্রফেসর ডা. শাহাবুদ্দিন, অধ্যাপক ডা. শামসুল আরেফিন, ডা. নূর উদ্দিন, প্রফেসর ডা. এফ এম সিদ্দিক, ডা. জাফর ও ডা. আল মামুন।

চিকিৎসকদের সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের লিভার প্রতিস্থাপন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে এ ধরনের অ্যাডভান্স হেলথ সেন্টার রয়েছে। সেখানকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে।

৭৯ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ফুসফুস, আর্থ্রাইটিস, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে বিভিন্ন সময়ে আইসিইউতে রেখে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে তাঁকে দীর্ঘ সময় চিকিৎসা নিতে হয়েছে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পরে সর্বশেষ ২১ আগস্ট এভারকেয়ার হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসাধীন থেকে বাসায় ফেরেন তিনি।

চিকিৎসকরা জানান, বেগম খালেদা জিয়াকে এমন একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে বিদেশে নেওয়া হবে, যেখানে সব ধরনের চিকিৎসা সহায়তার ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমান শর্ট ডিসটেন্সে তিন থেকে চার ঘণ্টায় যাওয়ার এয়ার অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। যেগুলোর মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে রোগী নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু লন্ডন যেতে ১৪ ঘণ্টার ‘লং ডিসটেন্স এয়ার অ্যাম্বুলেন্স’ পৃথিবীর মাত্র কয়েকটি দেশে রয়েছে। সেসব দেশের সঙ্গে চিকিৎসকরা আলোচনা করেছেন।

এভারকেয়ার হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়ার চিকিৎসাসেবায় সর্বদা নিয়োজিত রয়েছেন। এই টিমে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াও লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী কার্ডিওলজিস্ট ডা. জুবাইদা রহমান এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকজন চিকিৎসকও রয়েছেন।

খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্য জানান, বেগম জিয়া প্রথমে লন্ডন যাবেন পুত্র তারেক রহমানের কাছে। এরপর মেডিকেল বোর্ডের সমন্বয়ক ডা. জুবাইদা রহমানের দিকনির্দেশনায় মূল চিকিৎসা শুরু হবে। খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে দীর্ঘ সময়ের উড়োজাহাজ ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত কি না? সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ম্যাডাম আগের চেয়ে ভালো আছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তিনি দেশ ছাড়তে পারবেন।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির দুই মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাবন্দি হয়েছিলেন। দুই বছরের বেশি সময় তিনি কারাবন্দি ছিলেন। করোনার সময় ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। এরপর ৬ মাস পরপর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছিল সরকার। গত ৫ আগস্ট গণ আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে নির্বাহী আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এরপর থেকে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে বিএনপি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *