‘চাল দিছে- ত্যাল, নুন, তরি-তরকারির টাকা কনে পাবো?’

জাতীয়

“মাছ না মারলে কি খাবো? মাছ না ধরার জন্নি সরকারেরতে ২৫ কেজি চাল দিছে। এই চালে এক সপ্তাহও চলে না। যাও কষ্টেমষ্টে চলা যায় কিন্তু ত্যাল, নুন, তরি-তরকারির টাকা কনে পাবো?” এভাবেই আক্ষেপ করে কথাগুলি বলছিলেন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও রাজবাড়ীর পদ্মা নদীতে ইলিশ মাছ ধরতে আসা জেলে আজগর আলী।

তিনি আরও বলেন, “২৫ কেজি চালে তো জাল গুছিয়ে বারিত বসে থাকপার পারি নে বাজান। আপনের চাচিসহ পরিবারে আছে ৮ জন মানুষ। আপনের চাচির হার্ডের রোগ তার ওষুধ কিনা লাগে।“কয় মাস আগে জাল কিনার জন্নি এক এনজিও থেকে কিস্তি তুলছি। প্রত্তেক সপ্তায় কিস্তির টাকা দিয়া লাগে। এজন্নি জেলে যাওয়ার ভয় নিয়েই নদীতে মাছ ধরতি আইচি।”

গত ১৩ অক্টোবর থেকে দেশে ইলিশ ধরা বা আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলা ২২ দিনের এ নিষেধাজ্ঞায় দেশব্যাপী ইলিশ পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুদ এবং বিনিময়ও নিষিদ্ধ। কিন্তু তা উপেক্ষা করে স্বাভাবিক সময়ের মতই রাজবাড়ীর পদ্মায় মাছ শিকার করছেন জেলেরা। সরেজমিনে শনিবার থেকে সোমবার পদ্মার পাড় ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্রই।

প্রশাসনের কোনো জোরদার তদারকি না থাকায় সকাল-বিকাল নদী পাড়েই বসছে অস্থায়ী ইলিশের হাট, চলছে কেনাবেচা। কমদামে মাছ কিনতে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন ক্রেতারা। স্থানীয়দের অভিযোগ প্রশাসনের ঢিলেঢালা অভিযান থাকায় নিষেধাজ্ঞা মানছে না জেলেরা।

শনিবার রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়নের চরঝিকড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। পদ্মা পাড়ে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে শতাধিক মানুষ। সবাই আছে ইলিশের অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর দুটি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় মাছ নিয়ে পাড়ে ভিড়লো কয়েকজন জেলে। মুহূর্তেই হইচই শুরু হয়ে গেল। কে আগে মাছ নিবে- যেন সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।

পাড়ে থাকা জেলেদের সহযোগীরা দাঁড়িপাল্লা নিয়ে হাজির। এরপর শুরু হলো বেচা কেনা। এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয় ১১ থেকে ১২শ টাকা কেজি। আর সাত থেকে আটশ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হয় ৫ থেকে ৬শ টাকা দরে।সেই সাত সকালেই দেখা গেল আধা ঘণ্টার মধ্যেই কয়েক মণ মাছ বিক্রি শেষ। বরং মাছ না পেয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে অনেকেই।

শুধু যে হাবাসপুর ইউনিয়নের চরঝিকড়ি এলাকায় মাছ বিক্রি হচ্ছে তেমনটা নয়। জেলায় অন্তত ৫০টি পয়েন্টে মাছ বেচাকেনা হয়। অনেকেই আবার ঝুড়িতে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও মাছ বিক্রি করছেন।

পরদিন রোববার সকালে সদর উপজেলার উড়াকান্দা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীতে শুধু নৌকা আর নৌকা। ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো পদ্মার বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দেখে বোঝার উপায় নেই ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলছে।

মনে হচ্ছে স্বাভাবিক সময়ের মতই উৎসবমুখর পরিবেশে জেলেরা মাছ শিকার করছেন। কারও চোখে মুখে নেই প্রশাসনের ভয়, নেই জেল জরিমানার ভয়। নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে একই চিত্র দেখা গেছে সোমবার সকালেও। এ কয়েকদিনে নদীতে প্রশাসনের উপস্থিতি চোখে পড়ে নাই।

উড়াকান্দা এলাকার বাসিন্দা সালাম শেখ বলেন, “প্রচুর নৌকায় নদী থেকে মাছ ধরছে। আশপাশের নদীর পাড়েই বিক্রি হচ্ছে। গত বছর প্রশাসনের যে রকম নজরদারি ছিলো এ বছর তা নেই। এ কারণে জেলেরা আরামে মাছ ধরছে।”

স্থানীয় সুমন বিশ্বাস বলেন, “যাদের জন্য মাছ তারাই আইন অমান্য করে উৎসবের সাথে শত শত নৌকায় মাছ ধরছে। প্রতিবছর দেখি কঠোর অভিযান পরিচালনা হয়। কিন্তু এবার তার উল্টো। মৎস্যজীবিরা যদি এই মাছ না ধরে তাহলে ভবিষ্যতে তারা আরও বেশি মাছ পাবে এবং সারা বছর মাছ মারতে পারবে। “

তিনি আরও যুক্ত করেন, “আসলে কেউই ভালো না। ক্রেতারাও তো নিষেধাজ্ঞা না মেনেই কিনছে।”

মিজানপুর ইউনিয়নের কালিতলা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল গফুর মোল্লা বলেন, “সারা বছর জেলেরা যে মাছ পায় নদীতে এই কয়দিনে তার থেকে বেশি মাছ পাবে। এজন্য ছোট-বড় সবাই মাছ মারছে। চরে শত শত নৌকায় জেলেরা মাছ শিকার করছে।”

তিনি আরও বলেন, “মাছ আর টাকা উড়ছে। কিন্তু প্রশাসনের দেখা নেই। এই যে এক সপ্তাহের বেশি নিষেধাজ্ঞা চলছে কিন্তু প্রশাসন পারে এসে দেখে চলে যায়। প্রশাসন কঠোর না হলে মাছ ধরা থেকে জেলেদের আটকানো যাবে না।”

এদিকে ইলিশ ধরা নিষেধাজ্ঞাকালীন জেলেদের জন্য সরকার যে চাল বরাদ্দ দিয়েছে, তা প্রকৃত জেলেদের ভাগ্যে জোটেনি বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলেরা। সদর উপজেলার জেলে ঊজ্জল বলেন, “মাছ না ধরলে খাবো কি? সরকার থেকে ২৫ কেজি করে চাল দিছে। সেই চাল পেয়েছে যারা জেলে না তারা। অথচ প্রকৃত জেলেরা চাল পায় না। আবার যারা পেয়েছে তারাও মাছ ধরছে।

“শুধু চাল দিলেই কি হবে? তেল, লবণ, তরকারি কে দিবে? জাল, নৌকা কেনার জন্য ঋণ আছে প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয় সেই টাকা মাছ না মরলে তো দিতে পারবো না।”

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন নদী পাড়ে জাল মেরামত করা জেলে রহমত আলী। তিনি বলেন, “কার্ডধারী জেলে হওয়ায় ২৫ কেজি চাল পেয়েছি কিন্তু আমার পরিবারে রয়েছে ৮ জন সদস্য। সরকারের চালে ৫ দিনের বেশি চলে না। বাকি দিন কিভাবে চলব? যে কারণে বাধ্য হয়ে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাছ ধরি।”

রাজবাড়ীর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোস্তফা আল রাজীব বলেন, “কিছু জেলে এই সময় তাদের লোভকে নিয়ন্ত্রণ করতে পরে না। তারা প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নদীতে নেমে পড়ে। আমরা তাদের মোবাইলকোর্টের মাধ্যমে জেল জরিমানা করছি।

তিনি বলেন, “অল্প জনবল দিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। জেলায় যেখানে ৬০জন কর্মকর্তা কর্মচারী থাকার কথা সেখানে আছে মাত্র ২০জন।” “আমাদের মৎস্য পুলিশ দরকারা যারা সব সময় আমাদের সহযোগিতা করবে। এছাড়াও ম্যাজিস্ট্রি পাওয়ার দরকার, স্পিড বোট, লজিস্টিক সাপোর্টও দরকার, তাহলে ইলিশ রক্ষায় কঠোর নজরদারি করা সম্ভব।”

তারপরও নিয়মিত জেলেদের সচেতন করাসহ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে- বলেন এই মৎস্য কর্মকর্তা। তিনি জানান, জেলায় সাড়ে ১৪ হাজার জেলে থাকলেও এ বছর সা‌ড়ে ৫ হাজার জেলেকে ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে।

আর ইলিশ ধরার অপরাধে এ পর্যন্ত রাজবাড়ীতে ২২ জেলেকে জেল ও জরিমানা করার পাশাপাশি ৭০ হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ ও বিপুল পরিমাণ মাছ জব্দ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *