বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তৈরি ট্রাফিক সিগন্যাল বসছে রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ চারটি মোড়ে। হাইকোর্ট মোড় থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত সড়কে পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে এসব ট্রাফিক সিগন্যাল বসানো হবে।
ঢাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন ও ড. হাদিউজ্জামানের ছয়টি সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকারের সেবা সংস্থাগুলো। এর মধ্যে ট্র্যাফিক সিগন্যাল তৈরি ও সেগুলোর ব্যবহার নিয়ে কাজ করছে বুয়েট।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর এই দুই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনায় বসে আমদানি না করে বুয়েট থেকেই সিগন্যাল বানানোর প্রস্তাব দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেই প্রস্তাবে সম্মত হয়ে ট্র্যাফিক সিগন্যাল তৈরি করেছেন তাঁরা। এই ট্রাফিক সিগন্যাল ১৬ অক্টোবর বুয়েটে টেস্ট করা হয়। সেখানে পুলিশসহ অংশীজনদের সিগন্যাল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়।
ড. হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অংশ ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনের মোড় ও বাংলামোটর মোড় এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের অংশ কারওয়ান বাজার মোড় ও ফার্মগেট মোড়ে বসানো হবে ট্রাফিক সিগন্যাল।
যেভাবে কাজ করবে দেশি ট্রাফিক সিগন্যাল
এই সিগন্যাল দুভাবে কাজ করবে। এটি ‘সেমি অটোমেটেড সিগন্যাল এইড’। এখানে একটা বাটন (বোতাম) থাকবে, যেটাকে একবার ম্যানুয়াল আবার অটোমেটেড (স্বয়ংক্রিয়) করা যাবে। কম যানবাহন থাকলে নির্ধারিত সময়ের জন্য ‘অটোমেটেড মুডে’ চলবে। বেশি থাকলে ‘ম্যানুয়ালি’ সময় পরিবর্তন করে নেওয়া যাবে।
তিনি বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ যে ধরনের কাজ করে, সেই ধরনের সুবিধা এতে থাকবে।তাদের আর হাত দেখাতে হবে না। সিগন্যালের মাধ্যমে ট্রাফিক বাতি দেখানো হবে। পুলিশ চাইলে যেকোনো সময় যেকোনো সিগন্যালের সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সেখানে কিছু সতর্কতার ব্যবস্থা থাকবে। যেমন—কোনো সিগন্যালে বেশি সময় লাগলে সেটি জানা যাবে। পথচারী পারাপারের জন্যও আলাদা সিগন্যাল থাকবে। এটা যেকোনো সময় আপডেট করা যাবে।’
এই যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ হাতে যে কাজ করেন, সেটি এই সিগন্যাল থাকলে আর করতে হবে না। এখন চারজন ট্রাফিক সদস্য একটি মোড়ে কাজ করে। এই সিগন্যাল বসালে একজন অপারেট করবে, বাকিরা ফ্রি থাকবে। তখন তারা এনফোর্সমেন্টে ভালো কাজ করতে পারবে।’
ট্র্যাফিক পুলিশের সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকার সড়ক সংযোগগুলোতে মোট ট্রাফিক সিগন্যাল আছে ১১০টি। এগুলোর কোনোটিই কাজ করছে না। ফলে নগরীর সব জায়গায় ট্র্যাফিক পুলিশের সদস্যরা ম্যানুয়ালি যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সূত্র বলছে, ঢাকা শহরে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য গত ১৯ বছরে নানা উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ ও সিটি করপোরেশন। এগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা, কিন্তু কোনো কিছুই কাজে আসেনি। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০১২-২৩ অর্থবছরে ‘ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট’ (কেস) প্রকল্পের আওতায় ১১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯টি মোড়ে বসানো হয় সিগন্যাল বাতি। ২০১৬ সালের ঢাকার চারটি মোড়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিস্টেম বসানোর আরেকটি উদ্যোগ নেয় ডিটিসিএ। শুরুতে ব্যয় ছিল ৩৭ কোটি টাকা, পরে বেড়ে হয় ৫২ কোটি টাকা।
বুয়েটের তৈরি ট্রাফিক সিগন্যালে খরচ কত
হাদিউজ্জামান বলেন, ট্র্যাফিক সিগন্যালে আগে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো বাইরে থেকে আনা; খরচও বেশি। আবার নষ্ট হলে সেগুলো সারাতে অনেক অপেক্ষা করতে হয়। এভাবে সিগন্যালগুলো অকার্যকর হয়ে যায়। বুয়েটে তৈরি সিগন্যালের খরচ কম। তবে এটার আয়ুষ্কাল হয়তো বিদেশি সিগন্যালের মতো হবে না, তবে নষ্ট হলে দ্রুত সারানো যাবে।
তিনি বলেন, ‘এই সিগন্যাল ব্যবহার করে ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য পুলিশ সদস্যদের আপাতত প্রশিক্ষণের দরকার হবে না। শুরুতে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে বুয়েটের একজন অপারেটর থাকবেন। যেসব মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল বসানো হচ্ছে, সেখানে ট্রাফিক পুলিশ থেকে একজন ও বুয়েট থেকে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এতে করে পাইলটিংয়ের (পরীক্ষামূলক প্রয়োগ) সময়ে তাঁরা অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারবেন। পুলিশ বক্সগুলোও নতুন করে নির্মাণের চিন্তা চলছে। এই ব্যবস্থাপনার জন্য একটা আলাদা কক্ষ লাগবে। বুয়েট থেকেই সেটি ডিজাইন করে দেওয়া হবে।’
হাদিউজ্জামান বলেন, প্রাথমিকভাবে পাইলট প্রকল্পের জন্য প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যাল তৈরি ও বসানোর জন্য সাড়ে ১০ লাখ টাকা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে দেড় লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। পরে সিগন্যালের সঙ্গে রিমোট যুক্ত হতে পারে এবং সিগন্যালের পাশে আলাদা কাউন্টার বসানো যেতে পারে। এতে খরচ বাড়বে।
রক্ষণাবেক্ষণের খরচের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এটা চালাতে প্রতিটি মোড়ে তিনজন করে থাকবেন। তাদের একটা সম্মানী আছে। সবকিছু মিলিয়ে দেড় লাখ টাকা—এটা লো কস্ট সমাধান। কারণ, বিদেশ থেকে সিগন্যাল এনে শুরুতেই দুই থেকে তিন কোটি টাকা খরচ করা হয়। পরে নষ্ট হলে যন্ত্রাংশ দেশে পাওয়া যায় না; ছয় মাস বসে থাকতে হয়। এতে গত কয়েক বছরে প্রায় ২৫০-৩০০ কোটি টাকা জলে গেছে।