সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর আন্দোলন রূপ নিলো ভয়াবহ সহিংসতায়।সমাবেশ ঘিরে শনিবার (২৮ অক্টোবর) ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষে একজন পুলিশ সদস্য ও এক রাজনৈতিক কর্মী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ৪১ জন পুলিশ সদস্য ও ২৮ জন সাংবাদিকসহ আরও অনেকে আহত হয়েছেন।
প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা, পুলিশ হাসপাতাল-অ্যাম্বুলেন্স ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর, মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে দিনভর রাজধানীর নয়াপল্টন ও আশপাশের এলাকা ছিল রণক্ষেত্র।
সমাবেশ চলাকালে সংঘাত : পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শনিবার সকাল থেকেই রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশস্থলে অবস্থান নেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। অনেকে আবার শুক্রবার রাত থেকেই সেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের উপস্থিতিও বাড়তে থাকে সমাবেশস্থলে। দুপুর ২টায় সমাবেশ শুরুর কথা থাকলেও পৌনে ১টায় সমাবেশ শুরু করে বিএনপি। সমাবেশ চলাকালে হঠাৎ করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দলটির নেতাকর্মীরা। ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে মুহূর্তেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নয়াপল্টন এলাকা।
পুলিশ বলছে, বিএনপির নেতাকর্মীরা হুট করেই বেপরোয়া হয়ে হামলা শুরু করে। পুলিশ তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে সংঘাত শুরু হয়।অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের দাবি, পুলিশ তাদের ওপর হামলা চালিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ পণ্ড করে দিয়েছে। এজন্য তারা রোববার (২৯ অক্টোবর) সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে।
সংঘাত থেকে সহিংসতা : রাজধানীর নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ চলাকালে কাকরাইল এলাকার হেয়ার রোডে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের বাসভবনে হামলা চালানো হয়। তার বাসভবনের মূল ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে যায় দুর্বৃত্তরা। তারা প্রধান বিচারপতির বাসভবনের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে।
এ সময় রাজধানীর মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারে বলাকা পরিবহনের একটি বাসে, বিজয়নগরের নাইটিঙ্গেল মোড়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে এবং কমলাপুরে বিআরটিসির একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কাকরাইল পুলিশ বক্সেও আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। একই সঙ্গে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় সেখানে থাকা দুটি অ্যাম্বুলেন্স ও বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল।
সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায় : নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির কর্মীদের সহিংসতা এক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকাগুলোতে। রাজধানীর মিন্টো রোডের মুখে একটি বাসে ভাঙচুর করা হয়। বিজয়নগর, কাকরাইল, আরামবাগ, সেগুনবাগিচা, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বেশ কয়েকটি স্থানে বিএনপি-আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মোট ২৬টি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এ ছাড়া রাত ৯টার দিকে গাজীপুর ও সাভারে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
নিহত ও আহতের পরিসংখ্যান : রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে পারভেজ (৩২) নামে এক পুলিশ কনস্টেবল নিহত হয়েছেন। তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে।
এ ছাড়া নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে শামীম মোল্লা নামে এক যুবদল নেতা আহত হওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। সংঘাতে ৪১ জন পুলিশ সদস্য ও ২৮ জন সাংবাদিকসহ আরও অনেকে আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে র্যাব-বিজিবি : উত্তপ্ত নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১১ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। এরমধ্যে ৫ প্লাটুন রাতে রাজধানীতে টহল দেবে (রমনায় এক প্লাটুন, মতিঝিলে ২ প্লাটুন, পল্টনে ২ প্লাটুন)। আর প্রধান বিচারপতির বাসভবনে নিরাপত্তার জন্য আগে থেকেই ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন রয়েছে, সচিবালয়ে রয়েছে ২ প্লাটুন। অন্যদিকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে মাঠে নেমেছে র্যাব।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছেন, র্যাবের গোয়েন্দারা অন্য গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত ফুটেজ, সিসি ক্যামেরা ফুটেজসহ সংশ্লিষ্ট তথ্য বিশ্লেষণ করে দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করে যাচ্ছে।
ঢাকায় সহিংসতার নিন্দা যুক্তরাষ্ট্রের : এদিকে ঢাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশকে ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা সব পক্ষকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
শনিবার রাতে এক বিবৃতিতে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস বলেছে, ঢাকায় আজকের রাজনৈতিক সহিংসতার নিন্দা জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। একজন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন রাজনৈতিক কর্মী হত্যা এবং একটি হাসপাতাল পোড়ানোর ঘটনা অগ্রহণযোগ্য। সাংবাদিকসহ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতাও তেমনই। আমরা সব পক্ষকে শান্ত ও সংযমী হওয়ার আহ্বান জানাই। সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞার জন্য আমরা সব সহিংস ঘটনা পর্যালোচনা করব। সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাকাউন্ট ফর দ্য ব্যুরো অব সাউথ অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়ান অ্যাফেয়ার্স। একই সঙ্গে নিন্দা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডনাল্ড লু।
রাজনৈতিক দলগুলোর নতুন কর্মসূচি : পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে সমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি।
রোববার (২৯ অক্টোবর) সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে রাজপথের এই প্রধান বিরোধী দল। পাশাপাশি রাজধানীর আরামবাগে সমাবেশ শেষে জামায়াতে ইসলামীও একই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। শনিবার বিকেলে রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। রোববার দেশের সব মহানগর, জেলা, থানা ও উপজেলায় শান্তি সমাবেশ করার ঘোষণা দেন তিনি।
হরতালেও সব রুটে চলবে বাস : এদিকে রোববার বিএনপির ডাকা হরতালেও বাস চলাচল অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। শনিবার সন্ধ্যায় এক বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি জানায়, মালিক-শ্রমিকরা বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল প্রত্যাখ্যান করে ঢাকা শহর ও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে বাস-মিনিবাস চলাচল অব্যাহত রাখবেন। তবে যাত্রী পাওয়া সাপেক্ষে আন্তঃজেলা রুটে গাড়ি চলাচল করবে।
হরতাল নিয়ে যা বলছে পুলিশ : হরতালের নামে নৈরাজ্য করলে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান।
তিনি বলেছেন, হরতালের নামে কেউ যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন ও সাধারণের যানচলাচলে ব্যহত করেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।
অন্যদিকে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশের জনগণের জানমাল এবং সরকারি সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান বাংলাদেশ পুলিশের আইনি দায়িত্ব। পুলিশ জনগণকে সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নাগরিকরা চলাফেরার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন হলে বা আইনি সহায়তার প্রয়োজন হলে নিকটস্থ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে। নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে বাংলাদেশ পুলিশ সবসময় পাশে রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।