সবকিছু ঠিক থাকলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল নভেম্বরেই আসতে পারে। ভোট ডিসেম্বরের শেষে অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। এ অবস্থায় চলতি (অক্টোবর) মাসেই ভোট রাজনীতির হিসাব-নিকাশ শেষ করতে চায় দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এ নিয়ে দুটি দলই রাজপথে সরব। বিএনপি ও তার সহযোগীরা সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক ও খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে আন্দোলন করছে। অন্যদিকে বিএনপির এসব দাবিকে অযৌক্তিক জানিয়ে ক্ষমতাসীনরা তাদের অধীনেই নির্বাচন করতে অনড়। এরমধ্যে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়েও তৈরি হয়েছে ভিন্নমত। সব মিলিয়ে সবার প্রশ্ন, রাজনীতিতে আলোচিত অক্টোবরে কী হবে– সমঝোতা, না সংঘাত? নাকি অন্য কিছু?
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার মুক্তি, সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে কঠোর কর্মসূচির বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। সেক্ষেত্রে সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করার পাশাপাশি অবস্থান এবং হরতালের মতো কর্মসূচিও দেওয়া কথা ভাবছে বিএনপি।
দলটির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমাদের কর্মসূচি এবং আন্দোলন সবকিছু নির্ভর করছে শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়ার ওপর। সরকারকে পদত্যাগের শেষ আলটিমেটাম দেওয়া হবে। সরকার এতে সাড়া না দিলে তফসিল ঘোষণার আগেই ‘ডু অর ডাই’ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। সেটি অক্টোবরের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় সপ্তাহে হতে পারে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দাবি একটাই সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে, কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। অক্টোবরের মধ্যেই সরকারের পতন ঘটানো হবে। এই সরকারের ঘণ্টা বেজে গেছে। ওদের যেতে হবে, এটাই শেষ কথা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, এই অবৈধ সরকার নড়বড় করছে। দেশে-বিদেশে কোথাও তারা জায়গা পাচ্ছে না। কাজেই একটা জোরসে ধাক্কা দিলেই সরকারের পতন হবে। অক্টোবর মাসটি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিএনপির আরেক নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, খালেদা জিয়া যদি বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, তাহলে শেখ হাসিনার বেঁচে থাকাও কঠিন হয়ে যাবে। বিদেশেও স্যাংশন দেওয়া আছে, কোথায় পালাবেন আপনি (প্রধানমন্ত্রী)।
অন্যদিকে অক্টোবরজুড়ে উন্নয়নের চমক প্রদর্শন, জনসভাসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থেকে সরকারকে ‘পাহারা’ দিতে চান আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। রাজপথে বিরোধী দলের সহিংসতা দমনে সরব দলটি। কোনোভাবেই বিএনপিকে সহিংস কর্মকাণ্ড করতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ক্ষমতাসীন নেতারা।
দলটির নেতারা বলেন, সরকারের উন্নয়নের চমকে অক্টোবরেই বিএনপির রাজনীতির কবর হবে। আন্দোলনের নামে কেউ সহিংসতা করলে রুখে দেওয়া হবে। এ জন্য দলের নেতাকর্মীরা সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকবে। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। যারা নির্বাচনকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবে তাদের প্রতিহত করা হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি নাশকতার রাজনীতি না ছাড়লে তাদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। আগুন নিয়ে এলে হাত পুড়িয়ে দেয়া হবে, অস্ত্র নিয়ে এলে ভেঙে দেওয়া হবে। তারা মিটিং করতে গেলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি না নিলে খবর আছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন সঠিক সময়ে সংবিধান অনুযায়ী হবে। বাংলাদেশের জনগণ শেখ হাসিনা ছাড়া কাউকেই মেনে নেবে না। দেশের সব দৃশ্যমান উন্নয়ন একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া সম্ভব নয়।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, বিএনপি একটি অবৈধ দল। বাংলাদেশের মানুষ আর কখনও কোনো অবৈধ দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। আর তারা যদি নির্বাচনে বাধা দিতে আসে তাহলে রাজপথে প্রতিহত করা হবে।
আওয়ামী লীগের আরেক নেতা মির্জা আজম বলেন, বিএনপি বলেছে সরকারের পতন ঘটাবে। আমরা সরকারকে পাহারা দেব। তফসিল ঘোষণার আগপর্যন্ত প্রতিদিন রাজপথে থাকব। বিএনপিকে রাজপথে পরাজিত করেই আমরা আগামী নির্বাচনে বিজয় অর্জন করব।
দুই দলের এমন অনড় অবস্থানের মধ্যে নির্বাচন সামনে রেখে আগামী দিনে এই সংকটের বরফ গলবে কিনা, তা নিয়েই চলছে জল্পনা-কল্পনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তফসিল ঘোষণার আগেই বিরাজমান সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং সংলাপের মাধ্যমে এটি সম্ভব। কিন্তু সংলাপ নিয়েও আছে বিপত্তি। সংলাপে বসার আগেই দুটি দলই শর্তজুড়ে দিয়েছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকারের পদত্যাগের পাশাপাশি নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নেওয়ার পর সংলাপ হতে পারে। তবে, এটি মানতে নারাজ আওয়ামী লীগ। তারা বলছেন, সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের দাবি থেকে বিএনপি সরে এলে সংলাপ হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, রাজনীতিতে সংলাপের বিকল্প নেই। সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপের উদ্যোগ নিতে হবে। এতে বিরোধী দলের আস্থা ফিরে আসবে। সংকটও দ্রুত কেটে যাবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংলাপের মাধ্যমেই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হতে পারে। সংলাপ হতে হবে শর্তহীন। সমস্যার সমাধান না হলে সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, দুটি দলের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে ব্যাপক সংঘাত হতে পারে। নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে দুই পক্ষকেই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করা উচিত।