চীনে ক্রমবর্ধমান হুমকিতে বিদেশি সাংবাদিকরা

চীনে ক্রমবর্ধমান হুমকিতে বিদেশি সাংবাদিকরা

আন্তর্জাতিক
চীনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ক্রমশই ভীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে বিদেশি সাংবাদিক, তাদের চীনা সহকর্মী এবং উৎসগুলোকে মারাত্মক ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে নতুন এক উপায়ে। বৃদ্ধি পেয়েছে হয়রানি। ভীতির এই পরিবেশ এতটাই বেশি যে, কমপক্ষে ৬ জন সাংবাদিক চীন ছেড়ে গেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এক জরিপ রিপোর্টে এ কথা বলা হয়েছে। ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাব অব চায়না (এফসিসিসি) এই রিপোর্ট সংকলন করেছে। এ খবর দিয়েছে লন্ডনের অনলাইন দ্য গার্ডিয়ান।

এতে বলা হয়েছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে তার মধ্যে আছে অনলাইনে ট্রলিং, শারীরিক নির্যাতন, হ্যাকিং, ভিসা প্রত্যাখ্যান। এ ছাড়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, মামলা করার হুমকি দিতে সরকারি কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।

সাক্ষাতকার দিতে রাজি হয়েছেন এমন অনেক সূত্রের বিরুদ্ধে এসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে।

এফসিসিসি বলেছে, তারা এ বিষয়টি উদ্বেগের সঙ্গে তুলে ধরছে। কারণ, চীনে যেসব বিদেশির বিরুদ্ধে সিভিল বা ক্রিমিনাল মামলা করা হচ্ছে, তাদেরকে চীন ত্যাগ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। অতীতের ঘটনার ওপর ভিত্তি করেও তাদেরকে এই শাস্তি দেয়া হচ্ছে।

ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অধীনে চীন ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা দমনপীড়ন করা হচ্ছে ভয়াবহভাবে। হয়রান করা হচ্ছে বিদেশি মিডিয়া এবং তাদের স্টাফদের। এক বছরেরও বেশি সময় পরেও চীনের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক চেং লাই এবং ব্লুমবার্গে কাজ করা চীনা সাংবাদিক হেজ ফান জেলে রয়েছেন।

এফসিসিসি বার্ষিক ভিত্তিতে সদস্যদের ওপর জরিপ পরিচালনা করে তথ্য সংকলিত করে রিপোর্ট তৈরি করে। এ বছর সেই রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে সোমবার। এতে হয়রানি ও ভীতির সঞ্চার করার অধিক ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। এমন পরিবেশে বিদেশি বহু সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যম জরুরি এক্সিট প্লানের মধ্য দিয়ে চীন ত্যাগ করেছে। বিবিসির সাবেক প্রতিনিধি জন সুদওয়ার্থকে তার স্ত্রী ইভোনে মারে, সন্তানসহ চীন ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ইভোনে মারে ছিলেন আরটিই’র একজন বিদেশি প্রতিনিধি। তাদেরকে উল্লেখযোগ্য হারে হয়রান ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। অনুসন্ধানী রিপোর্টের কারণে জন সুদওয়ার্থের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল।

জন সুদওয়ার্থ বলেছেন, আমরা যখন তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসছিলাম চীন থেকে তখন সাদা পোশাকে আমাদের ও আমার শিশু সন্তানদের বিমানবন্দর পর্যন্ত পিছু নিয়েছিল পুলিশ। সেখানে কি রকম বিপজ্জনক পরিস্থিতি তা এতেই ফুটে ওঠে। নিরপেক্ষ সাংবাদিকতাকে মোটেও সহ্য করে না চীন।

এফসিসিসি বলেছে, সরকার বা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সূত্র কমপক্ষে আটজন বিদেশি প্রতিনিধির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা বা মামলা করার হুমকি দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ওইসব সাংবাদিককে রিপোর্টিং করার কারণে ব্যক্তিগত বড় ঝুঁকিতে ফেলা হয়।

এফসিসিসি দেখতে পেয়েছে, শতকরা ৬২ ভাগ প্রতিনিধিকে কমপক্ষে একবার পুলিশ বা অন্য কর্মকর্তারা রিপোর্টিংয়ে বাধা দিয়েছে। অন্যদিকে শতকরা ৪৭ ভাগকে এমন বাধা দিয়েছে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। শতকরা ১২ ভাগ প্রতিনিধি বলেছেন, তাদেরকে রিপোর্টিং থেকে বিরত রাখতে শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে বা অন্য রকম শারীরিক শক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।

গত গ্রীষ্মে হেনান প্রদেশে বন্যা হয়। এ সময় বিপর্যয় ও অনুসন্ধানী কর্মকর্তাদের ধামাচাপা দেয়া নিয়ে রিপোর্ট করছিলেন পশ্চিমা বেশ কিছু সাংবাদিক। এ জন্য তাদের ওপর ‘ক্ষুব্ধ জনতা’ শারীরিক হামলা চালায়। ওদিকে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি ধামাচাপার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে চীনের কেন্দ্রীয় সরকার। প্রতিনিধিদের চার ভাগের মধ্যে এক ভাগ বলেছেন, অনলাইনে অনিয়মের বিষয়ে রিপোর্টিং করার কারণে তাদেরকে টার্গেট করা হয়েছে। পূর্ব এশিয়ান বংশোদ্ভূত নারী সাংবাদিকদের বৈষম্যমূলকভাবে ট্রলিংয়ের শিকারে পরিণত হতে হয়েছে। বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে কর্মরত চীনা কর্মীদের যৌন অশ্লীলতা এবং উদ্বেগজনক শারীরিক সহিংসতার হুমকি দেয়া হয়।

ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওর প্রতিনিধি এমিলি ফেং বলেন, রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটি ব্লগে আমার অনেক রিপোর্ট প্রকাশ হয়। এতে সমালোচনাকে প্রকাশ করে দেয়া হয়। কিন্তু অর্ধ বছর পরে এসে আমার সেই রিপোর্টকে অবৈধ বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এরপর চীনের শত শত সামাজিক মাধ্যম বিষয়ক একাউন্টে আমার ছবি সহ মন্তব্য প্রকাশ হতে থাকে। তাতে বলা হয়, তাকে পিটিয়ে মারো। কোনো কোনোটিতে যৌনতার ভয় দেখানো হয়।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, এসব হামলা বা আক্রমণে সরাসরি উৎসাহ বা উস্কানি দেয়া হয় রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র সমর্থিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা থেকে। অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তারা এবং রাষ্ট্রদূতরা নিয়মিত পশ্চিমা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গালাগালি দিয়ে লিখে থাকেন।
অনেক সংবাদভিত্তিক আউটলেট চীনের বাইরে থেকে রিপোর্ট করার পন্থা বের করেছে। ২০২০ এবং ২০২১ সালে বহু সাংবাদিককে চীনে নিষিদ্ধ করার পর এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একে চীনে আন্তর্জাতিক রিপোর্টিংয়ের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত হিসেবে দেখা হয়। এ কথা বলেছেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের চীনা ব্যুরো থেকে বহিষ্কৃত প্রধান স্টিভেন লি মায়ার্স। বর্তমানে তিনি অবস্থান করছেন সিউলে।

বেইজিংয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ব্যুরো প্রধান জোনাথন চেং বলেছেন, তারা আমাদের দক্ষতার পরীক্ষা করছে। এক্ষেত্রে এমন কিছু বিষয় আছে, যা আমরা দূর থেকে করতে পারি না। এর বেশির ভাগই চীনের বাইরের বড় শহরগুলোতে আমাদের পাঠকদের সঙ্গে সম্পর্কিত। চীনা রিপোর্টাররা বর্তমানে অবস্থান করছেন তাইপে, সিঙ্গাপুর, সিডনি এবং লন্ডনে। তারা দূর থেকে রিপোর্ট করছেন অথবা ভিসা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছেন। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র গত বছর দুই দেশের সাংবাদিকদের জন্য ভিসায় বিধিনিষেধ শিথিল করতে রাজি হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি খুব সামান্যই। এফসিসিসি’র জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৪৬ ভাগ প্রতিনিধি বলেছেন, তাদের চীনের ব্যুরোতে স্টাফ সঙ্কট রয়েছে। কারণ, সেখানে তারা পর্যপ্ত সংখ্যক সাংবাদিক নিতে পারছেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *