প্রজনন মৌসুমেও ডিম পাড়তে আসছে না সামুদ্রিক কাছিম

প্রজনন মৌসুমেও ডিম পাড়তে আসছে না সামুদ্রিক কাছিম

দেশজুড়ে
প্রজনন মৌসুমেও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ডিম পাড়তে আসছে না সামুদ্রিক কাছিম। সোনাদিয়া থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত প্রায় ১৭০ কিলোমিটার বিস্তৃত সৈকতে ২০২০-২১ মৌসুমে কাছিমের ডিম সংগ্রহ হয় প্রায় ২১ হাজার। করোনার কারণে তখন সেখানে পর্যটক যায়নি।

চলতি মৌসুমে শুক্রবার পর্যন্ত প্রথম তিন মাসে ডিম সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৬৪৭টি। অথচ ফেব্রুয়ারিতেই শেষ হচ্ছে কাছিমের প্রজনন মৌসুম। জেলায় ছয়টি হ্যাচারি ডিম সংগ্রহের পর বাচ্চা ফুটিয়ে সাগরে ছাড়ে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ায় ডিম পাড়তে আসছে না কাছিম। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও সৈকতে মানুষের ব্যাপক যাতায়াত, হৈ-হুল্লোড়, উচ্চৈঃস্বরে গান-বাজনা, আলো জ্বালিয়ে রাখা এবং বাতি জ্বালিয়ে সাগরে মাছ শিকারের কারণে সৈকতকে নিরাপদ মনে করছে না কাছিম। এ ছাড়া কুকুর-শিয়ালের ভয় কাছিমের। কুকুর-শিয়ালের উপদ্রব মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ডিম পেলেই খেয়ে ফেলছে। এক সেন্ট মার্টিনেই কয়েক হাজার কুকুর। স্থানীয়দের দাবি, এই সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার।

গভীর সাগরের প্রাণী কাছিমের প্রজননের সময় শীতকাল। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাছিম সৈকতের বালুচরে আসে ডিম পাড়তে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সেন্ট মার্টিন থেকে সোনাদিয়া দ্বীপের বালুচর এলাকাটিই কাছিমের সবচেয়ে নিরাপদ প্রজননক্ষেত্র।

পরিবেশবাদী সংস্থা সেভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী মোয়াজ্জেম রিয়াদ বলেন, কাছিমের বাচ্চা যেখানে ফোটে বংশানুক্রমে সেখানে এসেই ডিম পাড়ে। এরা সাধারণত এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৮০০ কিলোমিটার দূর থেকে এসে ডিম পাড়ে। কিন্তু এরা কেন সৈকতে আসছে না সেটা খতিয়ে দেখে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি জানান, কাছিম ডিম পাড়ার জন্য অন্ধকারে গর্ত খোঁড়ে। সাধারণত এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে এক বসায় ১০০ থেকে ১৫০টি ডিম পাড়ে। বাচ্চা ফোটে ৬৫ দিনে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১০ সালের দিকে বেশ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সাগর পারে হ্যাচারি স্থাপন করে। কাছিমের ডিম সংগ্রহের পর হ্যাচারিতে বাচ্চা ফুটিয়ে সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে ছয়টি হ্যাচারি এই কাজ করছে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা এবং ইউএসএইডের অর্থায়নে ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (ন্যাকম) চারটি হ্যাচারি কাজ করছে। এর মধ্যে সোনাদিয়ায় দুটি এবং রামুর প্যাঁচারদ্বীপ সৈকত ও উখিয়া-টেকনাফের শীলখালি সৈকতে একটি করে হ্যাচারি আছে। আর সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের দুটি হ্যাচারি রয়েছে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কাছিমের ডিম সংগ্রহে নিয়োজিত হ্যাচারির কর্মী আবদুল আজিজ শুক্রবার কালের কণ্ঠকে জানান, এবার দ্বীপে কাছিমের তেমন দেখা মিলছে না। এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি কাছিম দ্বীপের সৈকতে ৩৪৩টি ডিম দিয়েছে। গত বছর একই সময় ডিম সংগ্রহ হয় এক হাজার ৫০০টি। তিনি বলেন, দ্বীপে কয়েক হাজার কুকুর। বর্তমানে শীত মৌসুমে পর্যটকদের ভিড়ের কারণে নির্জনে কাছিমের ডিম পাড়ার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে।

কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণাগারের (এফআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুর রহমান  বলেন, কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় যেখানে কাছিমের ডিম পাড়ার নিরাপদ স্থান, সেখানে পর্যটনের বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে কাছিমগুলো নিরাপদ পরিবেশ না পেয়ে ডিম ছাড়ার জন্য উঠতে পারছে না।

ন্যাকম প্রকল্পের উপপরিচালক শফিকুর রহমান জানান, কারোনাকালে ২০২০-২০২১ মৌসুমে সৈকতে ২১ হাজার ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ১৯ হাজার ডিম বাচ্চা ফুটানোর পর সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়। চলতি মৌসুমে শুক্রবার পর্যন্ত সোনাদিয়া দ্বীপে মাত্র একটি কাছিম উঠেছে ডিম পাড়তে। ওই কাছিমের ডিম পাওয়া গেছে ৭০টি। সৈকত এলাকার অন্য দুটি হ্যাচারির আওতায় পাওয়া গেছে ২৩৪টি ডিম।

কক্সবাজার জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা জানিয়েছেন, উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় দিন দিন কাছিমের সংখ্যা কমছে। সাগরের মাছ ধরা জেলে থেকে শুরু করে সাগরপারের পর্যটনকেন্দ্রিক বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণকারীদের অবাধ চলাচল কাছিমের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আর শব্দদূষণ ও রাতের বেলায় সাগরতীরের বৈদ্যুতিক আলো ও কুকুর-শিয়ালের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।

টেকনাফ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. মহিবুল্লাহ বলেন, হোটেল রিসোর্টের উচ্ছিষ্ট খাবার এবং সেখানকার আবহাওয়া কুকুরের বংশ বৃদ্ধির জন্য বেশ অনুকূল। আর সেন্ট মার্টিন সাগরবেষ্টিত হওয়ায় এখানকার কুকুর অন্য কোথাও যেতে পারে না।

জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘গত বছর থেকে আমরা সেন্ট মার্টিনে কুকুরগুলোকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছি। ’ তবে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, সেখানকার অর্ধেকের বেশি কুকুরেরই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *