রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পাঁচ বছর আজ। ওই হামলায় দেশি-বিদেশি ২০ জন নিহত হন। নৃশংস ওই হামলার পর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট।
এ সময় এলিট ফোর্স র্যাব এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের বিশেষ ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম আন্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের হাতে প্রায় দুই হাজার জঙ্গি ধরা পড়েছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, বোমা-গোলা-বারুদ-বিস্ফোরক।
অভিযানে শতাধিক জঙ্গি নিহত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানে এই মুহূর্তে জঙ্গি কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বসে নেই নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর সদস্যরা। তারা এখন সক্রিয় অনলাইন প্ল্যাটফরমে। তাদের ১৫ থেকে ২০টি গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপের মাধ্যমেই তারা সদস্য সংগ্রহ করছে। হামলার পরিকল্পনা করছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম জানান, এ মুহূর্তে জঙ্গিদের কোনো বড় হামলার সক্ষমতা নেই। তারা অনলাইনে সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে। আমরা তাদের গতিবিধি মনিটরিং করছি। তারা যখনই কোনো হামলার পরিকল্পনা করছে, তখনই তাদের ধরে ফেলছি।
তিনি বলেন, জঙ্গি তৎপরতার সব শেষ অবস্থা নিয়ে বৃহস্পতিবার (আজ) ব্রিফ করবেন কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান।
জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, হলি আর্টিজান হামলার পর থেকে আমরা এ পর্যন্ত ৪৯৩ জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছি। মামলা করেছি ১৮৪টি। ইতোমধ্যে ১১০টি মামলায় ১২৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। হলি আর্টিজানসহ দুটি মামলায় রায় হয়েছে। রায়ে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। সিটিটিসির ২৬টি হাই রিস্ক অভিযানে ৬৩ জঙ্গি নিহত হয়েছে। যারা গ্রেফতার হয়েছে, তাদের অনেকে এরই মধ্যে জামিন পেয়েছে। জামিনের পর কেউ কেউ লাপাত্তা। পালিয়ে থেকেই তারা অনলাইনে জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে। যারা জামিন পেয়েছে, তাদের সবার কার্যক্রম মনিটরিং করছি। কোনো জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পেলেই তাদের আইনের আওতায় আনছি। সবশেষ ২৬ জুন রাজধানীর রামপুরা এলাকা থেকে আনসার আল ইসলামের তিন জঙ্গি গ্রেফতার হয়।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হলি আর্টিজান হামলার পর থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত আমরা জঙ্গিবিরোধী ৬০৭টি অভিযান চালিয়ে প্রায় দেড় হাজার জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছি। আত্মসমর্পণ করেছে ১৬ জন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের মধ্যে জেমএমবির সদস্যসংখ্যা বেশি।
এদের সংখ্যা ৯৮৭ জন। এরপরই রয়েছে আনসার আল ইসলাম। এই সংগঠনের ২৫৬ জন সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। এছাড়া আল্লাহর দলের ১৭৯, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৭৮, হিযবুত তাহরীরের ৭৭ জন, হুজির ২৪ জন এবং শহীদ হামজা ব্রিগেডের একজন সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে ৬৩টি দেশি-বিদেশি অস্ত্র, ২৪৪ রাউন্ড গুলি, ৯৪টি বোমা, ৮০টি ডেটোনেটর এবং সাড়ে ১৬ কোজি বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বড় ধরনের হামালা চালানোর সক্ষমতা এই মুহূর্তে জঙ্গিদের নেই। তারা এখন অনেকটা অনলাইননির্ভর। তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে র্যাবের তৎপরতা অব্যাহত আছে।
২০১৬ সালের ১ জুলাই জঙ্গিরা রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ হামলা চালায়। তারা দেশি-বিদেশি ২০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এর মধ্যে নয়জন ইতালীয়, সাতজন জাপানি, একজন ভারতীয়, একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান দ্বৈত নাগরিক ও দুজন বাংলাদেশি। জঙ্গিদের প্রতিহত করতে গিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হন। তারা হলেন বনানী থানার ওই সময়ের ওসি সালাউদ্দিন আহমেদ ও ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল ইসলাম।
ওই ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গুলশান থানায় একটি মামলা করে পুলিশ। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবীর। হামলার পর ব্যাপক আলোচনায় ছিল নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম। কিন্তু চার্জশিটে তাকে আসামি করা হয়নি।
যাদের নামে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে তারা হলো-জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, হাদিসুর রহমান সাগর, শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। এদের মধ্যে খালেদ ও রিপনকে পলাতক দেখানো হয়। অন্যদের গ্রেফতার দেখানো হয়। যাদের নামে চার্জশিট দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে বড় মিজানকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন আদালত। বাকি সাতজনের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।
হলি আর্টিজানে হামলার পর সেখানে সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ নিহত হয় পাঁচ জঙ্গি। তারা হল-রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।
এছাড়া হলি আর্টিজান হামলায় জড়িত সন্দেহে বিভিন্ন ‘জঙ্গি আস্তানায়’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয় ৮ জঙ্গি। তারা হলো-তামীম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ান জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান।