দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে শনিবার (১৯ জুন) থেকে শুরু হতে যাচ্ছে চীন থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া সিনোফার্মের প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম। এরইমধ্যে দেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর এই ভ্যাকসিনটিকে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে।
রাজধানীর চারটি মেডিকেল কলেজসহ দেশের অন্যান্য ৬৩ জেলায় এক যোগে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। চীন সরকারের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া এই ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য ১০টি ক্যাটাগরিতে পাঁচ লাখ মানুষকে টার্গেট করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
চীন থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া পাঁচ লাখ ভ্যাকসিন প্রথমবারের মতন দেশে এসে পৌঁছায় ১২ মে। সিনোফার্মের তৈরি এই ভ্যাকসিন পরবর্তীতে ১৩ জুন চীনের দ্বিতীয় দফা উপহার হিসেবে ছয় লাখ ডোজ দেশে এসে পৌঁছায়। এগুলো দিয়েই মূলত এবার শুরু হতে যাচ্ছে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম। তবে এবার ভ্যাকসিন প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে ১০টি ক্যাটাগরির মানুষকে। নিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে সিনোফার্মের এই ভ্যাকসিন ১৮ বছরের নিচে কাউকে দেওয়া হবে না। এ ছাড়াও অন্যান্য রোগের উপসর্গ থাকলেও তাদেরকেও এই ভ্যাকসিন কর্মসূচির বাইরে রাখা হবে প্রাথমিকভাবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে ৪টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত বুথে দেওয়া হবে সিনোফার্মের ভ্যাকসিন। এই চারটি হাসপাতাল হচ্ছে—ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে একটি করে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কেন্দ্র হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে দুটি করে বুথ চালু থাকবে। বিশেষ বিবেচনায় মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদেরও এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে এসব কেন্দ্রে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, রাজধানী বাদে দেশে অন্যান্য জেলায় একটি করে ভ্যাকসিনেশন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এই কেন্দ্রগুলোতেও দুটি করে বুথ থাকবে। ভ্যাকসিন গ্রহীতার সংখ্যার ওপর নির্ভর করে বুথ চালু করা হবে। এক্ষেত্রে ১৫০-২০০ জনের জন্য একটি বুথ চালু করা যাবে বলে প্রাথমিকভাবে জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনায়। তবে ২০০-এর বেশি গ্রহীতা হলে দুটি বুথ চালু করতে হবে বলেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশের যে সব জেলায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নেই, সেসব জেলায় কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে জেলা সদর হাসপাতাল কিংবা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের যেকোনও একটিকে ভ্যাকসিনেশন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা দেবেন সিভিল সার্জন। ওই কেন্দ্রেও থাকবে দুটি বুথ। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত এসব বুথ খোলা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
চীনের সিনোফার্মের এই ভ্যাকসিন প্রথম ডোজ প্রয়োগের চার সপ্তাহ বা ২৮ দিন পরে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী যারা ইতোমধ্যেই সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করেও প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন পাননি, তাদের এই ভ্যাকসিন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পূর্বের মতন করেই নির্দিষ্ট কেন্দ্র থেকে এসএমএস’র মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জানানো হবে। কেন্দ্র পরিবর্তন করে এই ভ্যাকসিন নেওয়ার কোনো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না এবার।
দেশে ১০ ক্যাটাগরির মানুষকে দেওয়া হবে চীনের সিনোফার্মের ভ্যাকসিন। দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। একই সঙ্গে ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থী, সরকারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি, সরকারি ম্যাটস ও সরকারি আইএইচটি’র শিক্ষার্থীদের এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এছাড়াও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী ও পুলিশ সদস্যরা যারা আগে ভ্যাকসিন নেননি তাদের এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।
দেশে সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই যারা নির্ধারিত কেন্দ্রে ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছেন কিন্তু এক ডোজ ভ্যাকসিনও পান নি তাদের এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এছাড়াও বিদেশগামী বাংলাদেশি কর্মী, যাদের বিএমইটি নিবন্ধন কিংবা কার্ড আছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরা, বিডা’র আওতাধীন ও অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক সরকারি প্রকল্পে (পদ্মা সেতু প্রকল্প, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, এক্সপ্রেস হাইওয়ে প্রকল্প, রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র) সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার পরিচ্ছন্নতাকর্মী, সারাদেশে কোভিড-১৯ মৃতদেহ সৎকারে নিয়োজিত ওয়ার্ড/পৌরসভার কর্মী এবং বাংলাদেশে বসবাসরত চীনা নাগরিকরা পাবেন সিনোফার্মের এই ভ্যাকসিন।
সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল এবং ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থী, সরকারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি, সরকারি ম্যাটস এবং সরকারি আইএইচটি শিক্ষার্থীরা জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে স্টুডেন্ট আইডি’র তথ্য লিপিবদ্ধ করে ভ্যাকসিন নিতে পারবেন, কিন্তু দ্বিতীয় ডোজের ভ্যাকসিন গ্রহণের আগে জাতীয় পরিচয়পত্র সুরক্ষায় ওয়েব পোর্টালে/অ্যাপে নিবন্ধন করে নিতে হবে।
যাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে না: সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন ছাড়া কেউ ভ্যাকসিন পাবে না বলে জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনায়। তাছাড়া অন্য কোনো দেশ থেকে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণ করে বাংলাদেশে এলে দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে এ ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে না।
সিনোফার্মের এই ভ্যাকসিন ১৮ বছরের নিচে কাউকে দেওয়া হবে না। ভ্যাকসিন গ্রহণের সময় জ্বর থাকলে বা অসুস্থ থাকলে, ভ্যাকসিনজনিত অ্যালার্জির পূর্ব ইতিহাস থাকলে, প্রথম ডোজ গ্রহণের পর মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে তিনি এ ভ্যাকসিন নিতে পারবেন না। অনিয়ন্ত্রিত দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ঘা, অ্যাজমা, কিডনি রোগ, ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন এমন ব্যক্তি, ক্যানসারে আক্রান্ত এবং স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জনগোষ্ঠীর ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমএনসিঅ্যান্ডএইচ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক বলেন, প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকা নির্দিষ্ট বুথ থেকেই শিক্ষার্থীরা ভ্যাকসিন নেবেন। এক্ষেত্রে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের ফোকাল পয়েন্ট এবং নার্সিং অধিদফতরের একজনসহ প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি করে দেওয়া হবে। স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান এই কমিটি করে তারাই তাদের শিক্ষার্থীদের এই ভ্যাকসিন দেবে আমাদের তত্ত্বাবধানে।
তিনি বলেন, আমাদের খুব পরিষ্কার পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা পাঁচ লাখ মানুষকে দুইটা ডোজের টিকা দিয়ে কমপ্লিট করব। এখানে আগে যারা নিবন্ধন করে রেখেছেন তারা অগ্রাধিকার পাবেন। এবার অনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের কোনো কর্মসূচি থাকছে না বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
ডা. শামসুল হক বলেন, চীন দুই দফায় বাংলাদেশকে যে ১১ লাখ ডোজ সিনোফার্মের টিকা দিয়েছিল সেটা দিয়ে শুরু হচ্ছে এবার ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম। তবে এটা সবার জন্য নয়। এই ১১ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য ৫ লাখ মানুষকে টার্গেট করা হয়েছে, যাতে করে তাদের দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া যায়।
তিনি বলেন, আমাদের খুব পরিষ্কার পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা ৫ লক্ষ মানুষকে দুইটা ডোজের ভ্যাকসিন দিয়ে কমপ্লিট করব। এখানে আগে যারা নিবন্ধন করে রেখেছেন তারা অগ্রাধিকার পাবেন। একই সঙ্গে প্রবাসী শ্রমিক, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের শিক্ষার্থীরাও এ ভ্যাকসিন পাবেন।
উল্লেখ্য, ২৯ এপ্রিল নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশে চীনে উদ্ভাবিত সিনোফার্মা ভ্যাকসিন জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।
ওইদিন ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমাদের কমিটি এই ভ্যাকসিনের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা চীনের সিনোফার্মের ভ্যাকসিন জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছি।
তিনি বলেন, ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আসার পর প্রথমে এক হাজার জনের ওপর প্রয়োগ করে তাদের পর্যবেক্ষণ করা হবে। আমরা দেখব এই ভ্যাকসিনের সেইফটি এবং অ্যাফিকেসি কেমন। এরপর গণটিকাদান কার্যক্রমে সিনোফার্মের ভ্যাকসিনের ব্যবহার করা হবে।’
সিনোফার্মের তৈরি করোনাভাইরাসের এই ভ্যাকসিনের আনুষ্ঠানিক নাম বিবিআইবিপি-সিওরভি (BBIBP-CorV)। এ ভ্যাকসিন ২৮ দিনের ব্যবধানে দুই ডোজ করে নিতে হয়। পরীক্ষামূলক প্রয়োগে এ ভ্যাকসিন ৭৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ কার্যকরিতা দেখিয়েছে বলে জানিয়েছে উৎপাদনকারীরা।