চিলমারী বন্দর নিয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদন দিতে গিয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই/হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে রে’ গানটি গেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি কক্ষে একনেক সভা শেষে ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান জানান, শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের ভাওয়াইয়া গানটির কয়েকটি লাইন গেয়ে শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভায় সভাপতিত্ব করেন। একনেক কমিটির অন্যান্য সদস্য এ সময় আগারগাঁওয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত ছিলেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘চিলমারী কিন্তু একসময় বিখ্যাত বন্দর ছিল। দেশভাগের পর আসামের সঙ্গে লিংক নষ্ট হওয়ায় গুরুত্ব কমে গেছে। এখন যেহেতু আমরা আঞ্চলিক ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াচ্ছি, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গেও বাড়াচ্ছি। চিলমারী বন্দরটা আবার আগের জায়গায় যাবে। তখনই প্রধানমন্ত্রী আমাদের মনে করিয়ে দিলেন, হাঁকাও গাড়ি ভাই চিলমারী বন্দর।’
তিনি আরও বলেন, ‘চিলমারীর বন্দরটি একসময় খুবই নামকরা ছিল, অনেক জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। এ প্রকল্পটির মাধ্যমে আমরা সেই জাঁকজমকপূর্ণ অবস্থানটি ফিরিয়ে আনব। এর মাধ্যমে মূলত প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। এ বন্দরের সঙ্গে সড়ক রেল, নৌ যোগাযোগ স্থাপিত হবে।’
সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা বলেন, সভায় ‘হাঁকাও গাড়ি ভাই চিলমারী বন্দর’ লাইনটি গেয়ে প্রধানমন্ত্রী জানতে চান, সভায় অংশ নেওয়া আর কেউ এ গানটি জানেন কি না? জবাবে একজন সচিব বলেন, আমি জানি। কিন্তু আমার গলার সুর ভালো নয়। গান গাইলে এখানে কেউ থাকতে পারবেন না। এ সময় একটু হাস্যরসের সৃষ্টি হয় বলে জানান তিনি।
শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের ভাওয়াইয়া গান ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই/ হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে রে’ এখনো সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে টিকে থাকলেও, যে নামের ওপর গানটি রচিত সেই চিলমারী বন্দরের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।
গতকালের একনেক সভায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ‘চিলমারী এলাকায় (রমনা, জোড়গাছ, নয়ারহাট) নদীবন্দর নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা খরচে ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে।
স্লুইসগেট না বানানোর পরামর্শ : একনেক সভায় ১০টি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও জেলার টাঙ্গন ব্যারেজ, বুড়িবাঁধ ও ভুল্লিবাঁধ সেচসমূহের পুনর্বাসন, নদীতীর সংরক্ষণ ও সম্মিলিত পানি উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্প পাস হয়। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্প পাস করার সময় নতুন করে কোনো সুøইসগেট নির্মাণের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছেন। তিনি চান না পানির অবাধ প্রবাহে কোনো অস্বাভাবিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হোক।
এমএ মান্নান বলেন, ‘আমিও এর বিপক্ষে। কারণ দেখা যায়, ৫০-৬০ কোটি টাকা খরচ করে এগুলো নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এটি একবার ওঠালে নিচে নামতে চায় না। নামালে উঠতে চায় না। অহেতুক পয়সা নষ্ট হয়।’
একনেক সভায় ‘বিপিএটিসির প্রশিক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’ প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্প অনুমোদনকালে বলেছেন, আমলাদের প্রশিক্ষণে আরও মনোযোগ বাড়াতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে চার মাসের বদলে ১০ মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়া আলু রপ্তানির বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার পারমর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া নদী ড্রেজিংয়ের বিষয়ে বরাবরের মতো আবারও প্রধানমন্ত্রী তাগিদ দিয়েছেন বলে পরিকল্পনামন্ত্রী ব্রিফিংয়ে জানান।
একনেকে ১০ প্রকল্প অনুমোদন : একনেকে ৬ হাজার ৬৫১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকার দেবে ৫ হাজার ২১৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা, সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ৭৯৮ কোটি ৩ লাখ এবং বিদেশি ঋণ ৬৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, নতুন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ‘বরিশাল (দিনারেরপুল) লক্ষ্মীপাশা-দুমকি সড়ক (জেড-৮০৪৪) এর ২৭তম কিলোমিটারে পা-ব-পায়রা নদীর ওপর নলুয়া-বাহেরচর সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পটিতে ১ হাজার ২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ করা হবে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ‘মধুপুর-ময়মনসিংহ জাতীয় মহাসড়ক (এন-৪০১) যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ’ প্রকল্পটি ১ হাজার ১০৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা খরচে বাস্তবায়ন করা হবে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ‘চিলমারী এলাকায় (রমনা, জোড়গাছ, নয়ারহাট) নদীবন্দর নির্মাণ’ প্রকল্পটি ২৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা খরচে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের ‘বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্পটি ২১৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা খরচে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলাধীন ব্রাহ্মণগ্রাম-হাটপাঁচিল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় যমুনা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ এবং বেতিল স্পার-১ ও এনায়েতপুর স্পার-২ শক্তিশালীকরণ কাজ’ প্রকল্পটি ৬৪৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা খরচে বাস্তবায়ন করা হবে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘ঠাকুরগাঁও জেলার টাঙ্গন ব্যারেজ, বুড়িবাঁধ ও ভুল্লিবাঁধ সেচ প্রকল্পসমূহ পুনর্বাসন, নদীতীর সংরক্ষণ ও সম্মিলিত পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ’ প্রকল্পটির খরচ ২৯৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষিবীজ উন্নয়ন ও বর্ধিতকরণ’ প্রকল্পটির খরচ ৭২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে ধান শুকানো, সংরক্ষণ ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদিসহ আধুনিক ধানের সাইলো নির্মাণ (প্রথম ৩০টি সাইলো নির্মাণ পাইলট প্রকল্প)’ প্রকল্পটির খরচ ১ হাজার ৪০০ কোটি ২২ লাখ টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের ‘বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট-হরিপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ’ প্রকল্পটির খরচ ১ হাজার ৩০৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন মেয়াদে এটি বাস্তবায়ন করা হবে।
এছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ‘বিপিএটিসির প্রশিক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’ প্রকল্পটির প্রথম সংশোধন অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে প্রকল্পটির খরচ ৩৪৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ২০৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুনে বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও এর মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।