ব্যাংকগুলোতে আমানতে সুদহার কম পাশাপাশি বেশি নিরাপত্তা থাকায় দিনদিন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছেন বিনিয়োগকারীরা। সঞ্চয় অধিদপ্তরের এক তথ্যে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ৬৫ হাজার ৬২১ কোটি ১৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আর সুদ-আসলে গ্রাহকদের শোধ করা হয়েছে ৩৯ হাজার ৯১৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ, নিট বিক্রির পরিমাণ ২৫ হাজার ৭০২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। দেশের ইতিহাসে মাত্র সাত মাসে এত বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রির রেকর্ড নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘একটু বাড়তি আয় ও নিরাপদ হিসেবে অনেকেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। এছাড়া, ব্যাংকের আমানতের সুদহারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের রিটার্ন অনেক বেশি। অন্যদিকে, ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুদ একটু বেশি দিলেও তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কম।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগই আমানতের বিপরীতে ৩ থেকে ৬ শতাংশের বেশি সুদ বা মুনাফা দেয় না। কিন্তু সঞ্চয়পত্রে সুদ দেওয়া হয় ১১ শতাংশের ওপর।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল মাত্র ছয় মাসেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছে। তাছাড়া এবার জাতীয় বাজেটে ঘাটতি ধরা হয় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয়েছে ২৫ হাজার ৭০২ কোটি টাকার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৮ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে নিট বিক্রি বলা হয়।
বিক্রির ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এর বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৫ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার মেয়াদান্তে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে মেয়াদ পূর্তির আগে নগদায়নকাল হিসেবে ১ম বছর ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ, ২য় বছর ১০ শতাংশ, ৩য় বছর ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ, ৪র্থ বছর ১১ শতাংশ এবং ৫ম বছর ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যাবে। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার মেয়াদে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। তবে মেয়াদ পূর্তির আগে নগদায়ন করলে ১ম বছর ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ২য় বছর ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, ৩য় বছর ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং ৪র্থ বছর ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে মুনাফা প্রাপ্য হবেন।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। তবে মেয়াদ পূর্তির আগে নগদায়ন করলে ১ম বছর ১০ শতাংশ, ২য় বছর ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ, ৩য় বছর ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ হারে মুনাফা পাবেন। এছাড়া, ৫ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। তবে মেয়াদ পূর্তির আগে নগদায়নকাল হিসেবে ১ম বছর ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২য় বছর ১০ দশমিক ১৫ শতাংশ, ৩য় বছর ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ, ৪র্থ বছর ১১ দশমিক ২০ শতাংশ এবং ৫ম বছর ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যাবে। সঞ্চয়পত্র কারা এবং কি পরিমাণ কিনতে পারবেন: ৫-বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র সব শ্রেণি ও পেশার বাংলাদেশি নাগরিক এমনকী নাবালকের পক্ষেও কেনা যায়। এছাড়া, মৎস্য খামার, হাঁস-মুরগির খামার, পেলিটেট পোলট্রি ফিডস উৎপাদন, বীজ উৎপাদন, স্থানীয় উৎপাদিত বীজ বিপণন, গবাদি পশুর খামার, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের খামার, ব্যাঙ উৎপাদন খামার, উদ্যান খামার প্রকল্প, রেশম গুটিপোকা পালনের খামার, ছত্রাক উৎপাদন এবং ফল ও লতাপাতার চাষ হতে অর্জিত আয়-যা সংশ্লিষ্ট উপ-কমিশনার কর্তৃক প্রত্যায়নকৃত। ব্যক্তির ক্ষেত্রে একক নামে ৩০ লাখ অথবা যুগ্ম-নামে ৬০ লাখ এবং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই।
৩-মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে একজন প্রাপ্তবয়স্ক, একজন নাবালক, অথবা দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক তাদের যৌথ নামে ক্রয় করতে পারবেন। এছাড়া, যৌথভাবে অথবা যে কোনো একজনের লিখিত সম্মতিতে অন্যের মাধ্যমেও কেনা যাবে। এমনকি আদালত কর্তৃক উন্মাদ সাব্যস্ত ব্যক্তির পক্ষেও অভিভাবক বা ম্যানেজার নিযুক্ত হয়ে সঞ্চয়পত্র নেওয়া যাবে। পরিবার সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের যে কোনো বাংলাদেশি মহিলা, যে কোনো শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সীরা একক নামে সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকার কিনতে পারবেন।
আর পেনশনার সঞ্চয়পত্র মূলত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা- স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারী, সপ্রীম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিগণ, সশস্ত্রবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য এবং মৃত চাকুরিজীবীর পারিবারিক পেনশন সুবিধাভোগী স্বামী/স্ত্রী/সন্তানরা একক নামে সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারবেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলোতে বিনিয়োগ করা অর্থের ওপর একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর মুনাফা দেয় সরকার। মেয়াদপূর্তির পরে বিনিয়োগ করা অর্থও ফেরৎ দেওয়া হয়।