অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় দেশে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে।ক্রমবর্ধমান এ চাহিদার কারণে দেশের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয়েছে টোকিওভিত্তিক কোম্পানি জাপানস এনার্জি ফর আ নিউ এরা (জেরা)। জাপানের বিদ্যুৎ খাতের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ পরিকল্পনায় এখন অগ্রাধিকার পাচ্ছে বাংলাদেশ।
এরই মধ্যে বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন রিলায়েন্স পাওয়ারের বিদ্যুৎ প্রকল্পের ৪৯ শতাংশ ও সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ২২ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছে জেরা। এর বাইরেও দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ আরো বাড়ানোর আগ্রহ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এর মধ্য দিয়ে জেরা এখন হয়ে উঠছে দেশের বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম বড় অংশীদার।
জাপানভিত্তিক টেপকো ফুয়েল অ্যান্ড পাওয়ার ইনকরপোরেটেড ও চুবু ইলেকট্রিকের সমবিনিয়োগে ২০১৫ সালে যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জেরা। বৈশ্বিক এলএনজি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতের শীর্ষ কোম্পানি হয়ে ওঠার লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা করে প্রতিষ্ঠানটি।
এজন্য দেশে দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করতে থাকে জেরা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে প্রবেশ করে প্রতিষ্ঠানটি।
২০১৯ সালে নতুন ব্যবসায়িক পরিকল্পনার পাশাপাশি আয়-ব্যয়ের প্রক্ষেপণ প্রকাশ করে জেরা।এতে দেখা যায়, ২০২৫ সালের মধ্যে জাপানের বাইরের অন্যান্য দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জ্বালানি ব্যবসাকে মুনাফার সবচেয়ে বড় উৎস করে তোলার লক্ষ্য রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে গড়ে জাপানের অভ্যন্তরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবসা থেকে ৬০ শতাংশ মুনাফা করবে জেরা। ২০২৫ সালের মধ্যে এটি কমে দাঁড়াবে ৪০ শতাংশে। এর বিপরীতে এ সময় প্রতিষ্ঠানটির বৈশ্বিক জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবসার মুনাফা ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৬০ শতাংশে।
অর্থাৎ, জেরা এখন বহির্বিশ্বে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবসা বাড়ানোর মাধ্যমে মোট মুনাফায় জাপানের বাইরের ব্যবসার অংশ ২০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ২০১৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে ভারতের রিলায়েন্স পাওয়ারের ৭৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪৯ শতাংশ শেয়ার ক্রয়ের চুক্তি করে কোম্পানিটি। এটিই ছিল দেশের বিদ্যুৎ খাতে জেরার প্রথম বিনিয়োগ।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে অর্থায়নের জন্য রিলায়েন্স পাওয়ারের সঙ্গে গত বছরের জুলাইয়ে একটি ঋণ চুক্তি করে জেরা। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশনসহ (জেবিআইসি) বেশকিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে ৬৪ কোটি ২০ লাখ ডলারের ঋণ প্রদান করবে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও (বিপিডিবি) এরই মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়ার পর কেন্দ্রটি থেকে ২২ বছরের জন্য বিদ্যুৎ ক্রয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ফলে এখান থেকে জেরার দীর্ঘমেয়াদে আয় করার বিষয়টি এরই মধ্যে এক প্রকার নিশ্চিত।
২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর দেশের সবচেয়ে বড় স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানি (আইপিপি) সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ২২ শতাংশ শেয়ার ৩৩ কোটি ডলারে কেনার কথা জানায় জেরা।এর আগে একই বছরের মে মাসে জাপানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এ বিনিয়োগের বিষয়ে প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারকও (এমওইউ) সই হয়েছিল।
বাংলাদেশে সামিট গ্রুপের সব বিদ্যুৎকেন্দ্র সামিট করপোরেশন লিমিটেডের (এসসিএল) আওতাধীন। অন্যদিকে এসসিএলের শতভাগ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে সিঙ্গাপুরে ইনকরপোরেটেড সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের কাছে। এ সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ২২ শতাংশ শেয়ার কেনার মাধ্যমে দেশে সামিটের সব বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই মুনাফার অংশীদার হয়েছে জেরা।
সামিটের বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ৯৪১ মেগাওয়াট। এর বাইরে ৫৯০ মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাস বা আরএলএনজিভিত্তিক মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র-২ স্থাপনের কাজ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। তাছাড়া মহেশখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩ গিগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সামিটের।
টেপকো ও চুবু ইলেকট্রিক—জেরার স্বত্বাধিকারী দুটি প্রতিষ্ঠানেরই জাপান ও জাপানের বাইরে দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনের অভিজ্ঞতা রয়েছে।প্রতিষ্ঠান দুটির অভিজ্ঞতাই জাপান ও জাপানের বাইরে জেরার ব্যবসা দ্রুত সম্প্রসারণের পথ করে দিয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৮০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিদ্যমান বিনিয়োগের বাইরে দেশের এলএনজি ও বিদ্যুৎ খাতের অবকাঠামো উন্নয়নেও বেশ আগ্রহ দেখিয়েছে জেরা।প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, বাংলাদেশে এলএনজি টার্মিনাল, বৃহদায়তনের গ্যাস বা আরএলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং এলএনজি সরবরাহে আগ্রহ রয়েছে জেরার। মহেশখালীর মাতারবাড়ীকে শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও সহায়তা করতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানটি।
বিপিডিবির সর্বশেষ তথ্যানুসারে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২১ হাজার ২৩৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়েছে ৯ হাজার ৭৫ মেগাওয়াট।এছাড়া বেসরকারি ৫৩টি আইপিপি কেন্দ্রের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৭ হাজার ২৮৩ মেগাওয়াট।
দেশের বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তারা জেরার মতো প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসার মাধ্যমে অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে তাদের প্রত্যাশা, সরকার দেশী ও বিদেশী উদ্যোক্তাদের সমান সুযোগ প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের বিদ্যুৎ খাতে জেরার মতো প্রতিষ্ঠান অংশীদার হয়েছে, এটি ইতিবাচক। এ খাতের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার কারণেই বিদেশীরা এখানে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে।তাছাড়া এটি আমাদের এখানে বিনিয়োগের সম্ভাবনাকেও নির্দেশ করছে।
জেরার মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অংশীদারীর ভিত্তিতে ব্যবসা করলে এতে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছ থেকে প্রযুক্তিগতসহ অন্যান্য বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে। তবে সরকারকে একটি বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে, যাতে স্থানীয় ও বিদেশী কোম্পানি সবাই সমান সুযোগ পায়।
বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খাতে জেরার মতো জাপানি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক।
এ ধারাবাহিকতায় জাপানের বিনিয়োগ আকর্ষণে আগেকার বিনিয়োগ বোর্ডে জাপানের জন্য পৃথক ডেস্কও স্থাপন করা হয়েছিল।যে ডেস্কের মাধ্যমে বিনিয়োগ সহযোগিতার পাশাপাশি বিনিয়োগ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তিতেও সহায়তা করা হতো। এখন বিডায় জাপানের বিনিয়োগকারীদের জন্য পৃথক কোনো ডেস্ক না থাকলেও বাংলাদেশ নিয়ে দেশটির বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাস্তবায়নে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
জানতে চাইলে বিডা নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, আমি বিডায় যোগদানের আগেই জাপানের জেরা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বে আসে। আমি যোগদানের পর এখন পর্যন্ত জেরা নতুন কোনো প্রকল্প নিয়ে আসেনি বা যুক্ত হয়নি।
তবে জাপানের আরো অনেক কোম্পানি রয়েছে যারা বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রকল্প নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করছে। দেশে জাপানের বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নেরও কাজ চলছে। জাপানসহ বিশ্বের সব দেশ থেকেই বিনিয়োগ আকর্ষণের বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আর এক্ষেত্রে নীতিবৈষম্যের কোনো ধরনের সুযোগ নেই।