‘প্রণোদনার ঋণের অপব্যবহার হলে কঠোর ব্যবস্থা’

ঋণ-আমানত অনুপাতের নিচে ব্যাংকের বিনিয়োগ

বাংলাদেশ

ঋণ আমানতের অনুপাতের নিচে নেমে গেছে বেশির ভাগ ব্যাংকের বিনিয়োগ। তাই অনেক ব্যাংকই এখন নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না। যেটুকু ঋণ দেয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করা হচ্ছে। কারণ, ঋণ আদায় হচ্ছে না। এতে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ছে পুঞ্জীভূত সুদ। এই সুদই আবার মূল ঋণের সাথে যুক্ত হচ্ছে। নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বেশির ভাগ ব্যাংকের বিনিয়োগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া ঋণ আমানতের অনুপাতের অনেক নিচে নেমে গেছে। নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় এক দিকে ব্যাংকের মুনাফা বাড়ছে না। অপরদিকে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এতে বছর শেষে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সংশয় দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলো কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারবে তার সীমা বেঁধে দেয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। আগে প্রতিটি ব্যাংক বিনিয়োগ করতে পারতো মোট আমানতের ৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার আমানত নিয়ে ৮৫ টাকা বিনিয়োগ করতে পারতো। ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়া হয়। বলা হয়, এখন থেকে প্রচলিত ব্যাংকগুলো ১০০ টাকার আমানতের ৮৭ টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে। অপর দিকে ইসলামী শরিয়াহ আইন অনুযায়ী পরিচালিত ব্যাংকগুলো ৯২ টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগেরই ঋণ আমানতের অনুপাত ৮০ শতাংশের নিচে রয়েছে। আর সরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানতের অনুপাত রয়েছে ৭০ শতাংশের নিচে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বেশির ভাগ ব্যাংকই বিনিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। কারণ, করোনাভাইরাসের প্রভাবে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশে পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। এতে শিল্পকারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা সম্প্রসারণ করছেন না। তারা চলমান ব্যবসাই টিকে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেন না। তারাই ব্যাংকে ব্যাংকে ঋণ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন। এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক রয়েছে। ফলে নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে না। তবে, যে টুকু ঋণ বাড়ছে তার বেশির ভাগই বিদ্যমান ঋণের ওপর সুদ যুক্ত হয়ে বাড়ছে।

একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, প্রকৃত ঋণ না বাড়লেও আপনাআপনি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে পুঞ্জীভূত প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকার ঋণ আছে। প্রতি মাসেই এ ১০ লাখ কোটি টাকা ঋণের ওপর ৯ শতাংশ সুদ আরোপ করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করলে এতে সুদ আদায় হতো। সুদ সঞ্চিতি হতো না। কিন্তু ঋণ আদায় না হওয়ায় ১০ লাখ কোটি টাকার ঋণের ওপর ৯ শতাংশ হারে সুদ আরোপ হয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে ঋণের যে প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে তা প্রকৃতভাবে হচ্ছে না, কৃত্রিম প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ডিসেম্বর শেষে বসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। প্রতি মাসে সঞ্চিতি ঋণের সুদ বাদ দিলে প্রকৃত ঋণ প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে যাবে।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থান বেড়ে যায়। কারণ, ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তারা নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন করেন। এতে বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। ফলে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কিন্তু নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বছর শেষে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে। এ কারণে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করে তাদের মধ্যে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ব্যাংকারদের চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায় জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনই শুধু বাধাগ্রস্ত হবে না, ব্যাংকের মুনাফা কমে গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়বে ব্যাংকিং খাত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *