নির্বাচনে উৎসবমুখর চট্টগ্রাম

নির্বাচনে উৎসবমুখর চট্টগ্রাম

বাংলাদেশ

বহুল প্রতীক্ষিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) ভোটের বাকি আর মাত্র দুদিন। সোমবার মধ্যরাতেই শেষ হচ্ছে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা। শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় ব্যস্ত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ছুটছেন ক্লান্তিহীন। উৎসবমুখর পরিবেশে শেষ মুহূর্তের নির্বাচনী প্রচারণা এখন জমজমাট। বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রার্থীদের সমর্থনে কর্মী-সমর্থকদের স্লোগানে মুখরিত রাজপথ-অলিগলি।

চলচ্চিত্র-নাট্যজগৎসহ সাংস্কৃতিক জগতের তারকারাও মেয়র প্রার্থীদের হয়ে ভোট চাইছেন নগরীর পথেঘাটে ঘুরে ঘুরে। এমনকি করোনা সংক্রমণের ভয়ও যেন হার মেনেছে। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে এলাকা। নির্বাচনের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বাড়িতে বাড়িতেও। এখন শুধু অপেক্ষার পালা- কে ধরবেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হাল। সে জন্য অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে ২৭ জানুয়ারির রাত পর্যন্ত।
দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত বন্দরনগরীর এই নির্বাচনে ৭ জন মেয়র প্রার্থীসহ মোট ২৩৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে ৪১ ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থী ১৭২ জন, সংরক্ষিত ১৪টি আসনে ৫৭ জন নারী কাউন্সিলর প্রার্থী লড়াই করবেন ভোটে। চসিকের এবারের পুরো ভোটই নেয়া হচ্ছে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন)। কোনো ব্যালট পেপার ব্যবহার হবে না।

তাই ব্যালট পেপার ছিনতাই, জোর করে সিল মারার সুযোগও থাকছে না কারো পক্ষেই। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে ভোটকেন্দ্র রয়েছে ৭৩৫টি। মোট ভোটার ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। এর মধ্যে নারী ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৩ জন এবং পুরুষ ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৩ জন। আর এই পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১০ হাজারেরও বেশি সদস্য মোতায়েন থাকবে। আর মাঠে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরাও থাকবেন।

নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের গণসংযোগ ও প্রচারণায় সরগরম নির্বাচনী মাঠ। দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রচারণায় অংশ নেয়ায় নির্বাচনে যোগ হয়েছে বাড়তি মাত্রা। দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সব দ্ব›দ্ব ভুলে থাকার চেষ্টা করছেন দুই দলের নেতাকর্মীরা। তবে এর মধ্যেও যে সংঘাত, হতাহতের ঘটনা ঘটেনি তা কিন্তু নয়। তবে তুলনামূলক অনেকটা

কম আগের তুলনায়। ভোটারদের মন জয় করতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে প্রার্থীরা ছুটছেন এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। শোনাচ্ছেন উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রæতি। তবে ভোটাররা বলছেন, সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকেই বেছে নেবেন তারা। এদিকে এই নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের যেমন আগ্রহের শেষ নেই; তেমনি শঙ্কাও রয়েছে। তবে সে শঙ্কা সাধারণ উৎসবমুখর গণতন্ত্রপ্রিয় ভোটারদের আগ্রহে কেটে যাবে বলেই বিশ্বাস নগরবাসীর।

এদিকে নির্বাচনী প্রচারণার শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরীর সমর্থনে প্রচারণায় নেমেছেন দেশের খ্যাতনামা চলচ্চিত্র তারকা ও শিল্পীরা। গতকাল রবিবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে প্রচারণায় নামেন চলচ্চিত্র তারকা রিয়াজ, মীর সাব্বির, অরুণা বিশ্বাস, অপু বিশ্বাস, তারিন, তানভীন সুইটি, বিজরী বরকত উল্লাহ, বাঁধন, মাহিয়া মাহি ও রোকেয়া প্রাচী প্রমুখ। তারকারা নিউমার্কেট মোড়, কাজীর দেউড়ি হয়ে ইস্পাহানি-জিইসি মোড়, ষোলশহর ২ নং রেলগেট, অক্সিজেন মোড়, মুরাদপুর-বহদ্দারহাট হয়ে কর্ণফুলী নতুন ব্রিজ মোড়ে গিয়ে প্রথম দিনের প্রচারণার কার্যক্রম শেষ করেন।
ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, প্রার্থীদের প্রচারে ততই সরগরম রাজনীতির মাঠ। নগর উন্নয়ন ও বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে প্রধান দুই দলের মেয়র প্রার্থী দিয়েছেন নানা প্রতিশ্রুতি। ভোটের মাঠে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি শুনতে ভোটাররা অভ্যস্ত হলেও কোনো প্রার্থী প্রতিশ্রুতি পূরণে কতটুকু সক্ষম, সেই হিসাব-নিকাশও করছেন ভোটাররা। তবে এবার ভোটের দিন নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ ছুটি থাকছে না।

এদিন সব সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলবে। আর কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের সুবিধার্থে অন্যান্য দিনের মতো যানবাহনও চলবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর। চসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ভোটের দিন যেসব প্রতিষ্ঠান ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে, শুধু সেগুলো বন্ধ থাকবে। এছাড়া অন্যান্য অফিস চালু থাকবে। মানুষ যাতে নিজ নিজ কর্মস্থলে যাতায়াত করতে কোনো অসুবিধায় না পড়ে, সে জন্য যান চলাচলেও কোনো বিধিনিষেধ থাকছে না।

চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুই প্রার্থী ছাড়া আরো ৫ জন মেয়র প্রার্থী আছেন। তবে তাদের তেমন প্রচারণা নেই। আগামী ২৭ জানুয়ারি চসিক নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে ১৭১ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৫৭ জন প্রার্থী বিরামহীন প্রচারণা চালাচ্ছেন ওয়ার্ডকেন্দ্রিক। তারাও ভোটারদের দিচ্ছেন নানান প্রতিশ্রুতি। এছাড়া লিফলেট বিলি ও হ্যান্ডমাইকে প্রচারণা, প্রার্থী ও প্রার্থীদের পক্ষে রাজনৈতিক নেতাদের প্রচারণায় এখন সরগরম পুরো নগর।

এদিকে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই সহিংস হয়ে উঠছে পরিবেশ। প্রতিদিনই প্রতিদ্ব›দ্বী মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এতে ভোটারদের মধ্যেও শঙ্কা রয়েছে। জানা গেছে, এ পর্যন্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা ৫৩টি অভিযোগ জমা দিয়েছেন। নির্বাচনী সংঘাতে নিহত হয়েছেন ২ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চেকপোস্ট বসিয়ে চালাচ্ছে তল্লাশি। করছে মাইকিংও।

আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী এবং বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন গত ২৩ জানুয়ারি একইদিন এক ঘণ্টার ব্যবধানে নিজেদের ইশতেহার ঘোষণা করেন। বরাবরের মতোই তাতে রয়েছে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন, যানজট সমস্যা থেকে উত্তরণ, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, সড়কে আলো জ্বালানো, নালা-নর্দমা পরিষ্কার, গৃহ কর ও আবাসন সুবিধা, পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ চট্টগ্রাম গড়া, সাম্য-সম্প্রিতি, নান্দনিক পর্যটন নগর এবং তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ নগর গড়াসহ প্রতিশ্রুতি   ফুলঝুড়ি। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী ঘোষিত ইশতেহারে নগরের স্বাস্থ্যসেবা খাত, রাজস্বসহ সব সেবা খাতকে ‘ওয়ান স্টপ’ ডিজিটাল সার্ভারের আওতায় আনাসহ ১০০ দিনের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলমান মহাপরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টি তুলে ধরে ৩৭টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্যদিকে জলাবদ্ধতামুক্ত, স্বাস্থ্যকর, শিক্ষাবান্ধব, গৃহ কর ও আবাসন সুবিধা, পরিচ্ছন্ন চট্টগ্রাম, নিরাপদ, সাম্য-সম্প্রীতির, নান্দনিক পর্যটন নগর এবং তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম গড়তে ৭৫ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইশতেহার ঘোষণা করেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন।

নগর এবং স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতিতে অনেক বড় বড় স্বপ্নের কথা রয়েছে। কিন্তু সেসব স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়নযোগ্য তা ভেবে দেখা দরকার। এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়া উচিত নয়, যা একজন মেয়রের পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কিন্তু নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে অহেতুক মিথ্যা আশ্বাসই দেয়া হচ্ছে বারবার। সিটি করপোরেশন কিভাবে কাজ করবে এবং সেখানে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কী হবে- তা বর্ণনা করা আছে স্থানীয় সরকার সিটি করপোরেশন আইনের ৪১নং ধারায়। সাধারণত সড়কের আলোকায়ন, নালা-নর্দমা পরিষ্কার ও ময়লা অপসারণ- এসবের বাইরে খুব একটা যাওয়ার সুযোগ নেই মেয়রের।

তবে মেয়রের ব্যক্তিগত দক্ষতার ওপর নির্ভর করে অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে তিনি কতটা সমন্বয় করতে পারছেন এবং বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ নিতে পারছেন। তাই সিটি করপোরেশনের যে আইনি ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা বিবেচনায় রেখে ভোটারদের সুচিন্তিত রায় দিতে হবে। ভোটারদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নই নির্বাচিত মেয়রের মূল চ্যালেঞ্জ।

সিরাজুল ইসলাম নামে নগরীর এক ভোটার বলেন, নির্বাচনের সময় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা নানা প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কিছুই বাস্তবায়ন করেন না। পরিকল্পনা প্রতিশ্রুতি এর আগেও অনেকে দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন কতটুকু হয়? কেবল পরিকল্পনার মধ্যে বসে থাকলে হবে না। যিনিই নির্বাচিত হোন, মানুষের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হবে, কাজ করতে হবে।

ইসমাইল হোসেন নামে বাকলিয়ার এক ভোটার বলেন, মেয়র প্রার্থীরা আগেও নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে; কিন্তু পুরোপুরি সমাধান হয়নি। কেবল গালভরা প্রতিশ্রুতিই নয়, যেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেগুলো বললেই ভালো। প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজ না করলে বড় বড় কথা বলা উচিত নয়।

এদিকে ২৫ জানুয়ারি মধ্যরাত থেকে ২৯ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের বিভিন্ন অপরাধ আমলে নিয়ে বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৪১টি ওয়ার্ডে ২০ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া চসিক নির্বাচন উপলক্ষে তিনদিন যান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন কমিশন পরিচালনা-২ অধিশাখার উপসচিব মো. আতিয়ার রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে ২৫ জানুয়ারি রাত ১২টা থেকে ২৮ জানুয়ারি দুপুর ৩টা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশের কথা জানানো হয়। এই তিনদিন মোটরসাইকেল, সিএনজি, মাইক্রোবাস, জিপ ও পিকআপসহ সড়কে যানচলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে বলা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে থাকা দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম কর্মী, নির্বাচনী কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, নির্বাচনের বৈধ পরিদর্শক এবং জরুরি সেবা প্রদানকারী অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ডাক, টেলিযোগাযোগ প্রভৃতি কার্যক্রমে ব্যবহৃত যানবাহনের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা থাকবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *