ভ্যাকসিন কূটনীতিতে চীনকে পেছনে ফেলেছে ভারত

ভ্যাকসিন কূটনীতিতে চীনকে পেছনে ফেলেছে ভারত

আন্তর্জাতিক

নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে নয়াদিল্লির সামনে এমন সুবর্ণ সুযোগ আর কখনো আসেনি কিছু সময়ের জন্য হলেও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে চীনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার এখন ভারতের হাতে।

চীন ও ভারত দুই দেশই এখন করোনা পর্যুদস্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সামনে কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিনের ডালি সাজিয়ে শুভেচ্ছার বার্তা নিয়ে এগিয়ে আসছে। যদিও চীনা ভ্যাকসিনের প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আগ্রহ দেখা যাচ্ছে কম। অন্যদিকে পাকিস্তান ছাড়া এ অঞ্চলের সব দেশই এখন ভারতের কাছ থেকে ভ্যাকসিন নিতে মুখিয়ে রয়েছে।

গত কয়েক বছরে আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে অনেকটাই একা হয়ে পড়ার শঙ্কার মধ্য দিয়ে গিয়েছে ভারত বিতর্কিত সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ), জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্ট্রার (এনপিআর), জাতীয় নাগরিক তালিকা (এনআরসি), তিস্তা ইস্যু, বাংলাদেশীদের নিয়ে অমিত শাহর কটূক্তিসহ নানাবিধ কারণে উষ্ণতা হারাচ্ছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক।

নেপালের পার্লামেন্টে অনুমোদিত নতুন মানচিত্র নিয়ে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে নয়াদিল্লির। অন্যদিকে শ্রীলংকায় দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছিল চীনের উপস্থিতি। চিরবৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গেও এ মুহূর্তে সব ধরনের কূটনৈতিক আলোচনা একেবারেই বন্ধ রেখেছে ভারত।

এ অবস্থাতেই গত বছরের মে মাস থেকে লাদাখ সীমান্তে চীনের সঙ্গে এক ধরনের সামরিক অচলাবস্থায় জড়িয়ে পড়ে নয়াদিল্লি। কয়েক বছর ধরে এমনিতেই কিছুটা অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল ভারত।এ পরিস্থিতিকে আরো সংকটপূর্ণ করে তুলেছে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব। এ অবস্থায় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে আবারো উষ্ণতা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছে দেশটি।

চলতি বছরটিকে কূটনৈতিক প্রয়াসের মাধ্যমে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বছর হিসেবেই দেখছে নয়াদিল্লি। এ বিষয়ে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক লড়াইয়ে ভারতকে অনেকটাই এগিয়ে রাখছে কভিড-১৯

এর ভ্যাকসিন।নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় সুলভে সরবরাহের জন্য অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে ভারতের পুনেভিত্তিক সেরাম ইনস্টিটিউট। যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে এ ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা দাঁড়াতে পারে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত।

এছাড়া দেশটির স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক উদ্ভাবন করেছে কোভ্যাক্সিন নামে আরো একটি ভ্যাকসিন। এটিও জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগের জন্য অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার।ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা সম্পর্কে সেভাবে কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও ভারত সরকারের দাবি, এটি ১১০ শতাংশ পর্যন্ত নিরাপদ।

অন্যদিকে ব্রাজিলে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে দেখা গিয়েছে, চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক বায়োটেক উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন সর্বোচ্চ ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে।এদিকে চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোফার্ম গত ৩০ ডিসেম্বর জানায়, প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৭৯ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

চলতি মাসের শুরুর দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) জানিয়েছে, সেখানে ফেজ-৩ ট্রায়ালে সিনোফার্মের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রমাণ হয়েছে ৮৬ শতাংশ পর্যন্ত।বর্তমানে ভারত নিজ দেশের ৩০ কোটি নাগরিককে টিকা দেয়ার এক বৃহৎ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

এর পাশাপাশি সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ডঅ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড এবং ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিনকে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্যও কাজে লাগাতে চাইছে দেশটি। ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের গণ্ডি পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র পাকিস্তান বাদে আর সব দেশেই ‘টিকার কূটনৈতিক উপহার’ নিয়ে উষ্ণতার বার্তা পাঠাতে চাইছে দেশটি।

ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ এবং মিয়ানমার, মরিশাস ও সেশেলসের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোয় ভারত সব মিলিয়ে ১ কোটি ডোজ টিকা উপহার হিসেবে পাঠাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তাই বলে নিশ্চুপ বসে নেই চীনও। বেইজিংও চাইছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো চীনা ভ্যাকসিন সংগ্রহ করুক। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই এ নিয়ে একটি অনলাইন সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।এতে চীন ছাড়াও বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা অংশ নেয়।

অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে ভারত, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে তাতে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি বেইজিং। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ছাড়া আর সব দেশের হাবভাবেই পরিষ্কার, সবাই এখন শুধু সেরামে উৎপাদিত ভ্যাকসিন নিয়েই ভাবছে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও ধারাভাষ্যকাররা বলছেন, ভারত এ মুহূর্তে কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়েই দেখছে উদাহরণ হিসেবে তারা বলছেন, বাংলাদেশকে কাছে টানতে দেশটি এখন পর্যন্ত সিএএর পদ্ধতিগত ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্ত করেনি।

অন্যদিকে ভারত-নেপাল যৌথ কমিশনের বৈঠকে অংশ নিতে বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লি পৌঁছেছেন নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ গাওয়ালি। নেপালের প্রধানমন্ত্রী দেশটির মানচিত্রে ভারতের দাবি করা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে যৌথ কমিশনের বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হবে জানালেও বিষয়টিতে বিপরীত অবস্থানে নয়াদিল্লি। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর বলেছেন, যৌথ কমিশনের বৈঠকে মানচিত্র নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই।

এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অনেকটা বিরোধ এড়াতেই বৈঠকে ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা করতে চাইছেন না ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী।এদিকে গতকাল যখন দুই দেশের যৌথ কমিশনের বৈঠক চলছিল, ঠিক সে সময়ই জরুরি ভিত্তিতে সেরামের কোভিশিল্ড ব্যবহারের অনুমোদন দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে নেপাল।

এর আগে চলতি মাসের শুরুর দিকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য শ্রীলংকা সফরে যান সুব্রামনিয়াম জয়শংকর ওই সময় তিনি কলম্বোকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসেন, রফতানির জন্য প্রস্তুত হওয়া মাত্র ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে শ্রীলংকাকে অগ্রাধিকার দেবে ভারত।

অন্যদিকে মালদ্বীপ সরকার এরই মধ্যে সেরামের কোভ্যাক্সিন সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েই রেখেছে। ভারতও বলছে, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার মতো মালদ্বীপকেও ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেবে নয়াদিল্লি।

সব মিলিয়ে বলা চলে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভ্যাকসিন কূটনীতিতে ভারতের তুলনায় এখনো যোজন যোজন পিছিয়ে চীন। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এদিক থেকে বেইজিংয়ের পারফরম্যান্স মোটামুটি ভালো।এরই মধ্যে মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে চীন।

তবে বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত কম্বোডিয়া বলছে, আন্তর্জাতিক কোভ্যাক্স কর্মসূচির বাইরে থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের কথা আপাতত ভাবছে না দেশটি। এর বাইরেও কয়েকটি দেশে চীনা ভ্যাকসিন সরবরাহের সুযোগ তৈরি করে নিতে পেরেছে বেইজিং। ইউএইর শাসক শেখ মোহাম্মাদ বিন রাশিদ আল মাকতুম স্বয়ং সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগে অংশ নিয়েছেন। এছাড়া তুরস্ক, ব্রাজিল ও মেক্সিকোতেও ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে চীন।

এর পরেও সার্বিক পরিসংখ্যান বিবেচনায় বলা চলে, প্রাকসরবরাহ অর্ডারের দিক থেকে পশ্চিমে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনগুলোর সঙ্গে খুব একটা পেরে উঠছে না চীনা ভ্যাকসিনগুলো।এখন পর্যন্ত দেশটি সারা বিশ্বে সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম—এ দুটি ভ্যাকসিন সরবরাহের অর্ডার পেয়েছে সব মিলিয়ে ৫০ কোটি ডোজ।

অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী শুধু ফাইজারের ভ্যাকসিনটিরই সরবরাহের মোট অর্ডার রয়েছে ৫০ কোটি ডোজ। সবচেয়ে বেশি রয়েছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের—২৫০ কোটি ডোজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *