বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন আর নেই (ইন্নালিল্লাহি… রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর । গতকাল বিকাল ৫টায় তিনি ঢাকার বনানীর নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে শোক নেমে এসেছে।
সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আজ দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রাবেয়া খাতুনের মরদেহ রাখা হবে। দুপুর ২টায় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে মরহুমার দাফন বনানী কবরস্থানে সম্পন্ন হবে।
মৃত্যুকালে তিনি দুই পুত্র, দুই পুত্রবধূ, দুই কন্যা ও দুই জামাতাসহ নাতি-নাতনি ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
বড় মেয়ে কেকা ফেরদৌসী বিশিষ্ট রন্ধনবিদ। বড় জামাতা মুকিত মজুমদার বাবু টেলিভিশন উপস্থাপক, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং চ্যানেল আই ও ইমপ্রেস গ্রুপের পরিচালক। ছোট জামাতা জহির উদ্দিন মাহমুদ মামুন বিশিষ্ট শিল্পপতি, চ্যানেল আই ও ইমপ্রেস গ্রুপের পরিচালক। বড় পুত্রবধূ কনা রেজা বিশিষ্ট নারী উদ্যোক্তা ও পানসুপারীর স্বত্বাধিকারী। ছোট মেয়ে ফারহানা কাকলী সুগৃহিণী।
কথাসাহিত্যিক হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও রাবেয়া খাতুন এক সময় শিক্ষকতা করেছেন। সাংবাদিকতার সঙ্গেও দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। ইত্তেফাক, সিনেমা পত্রিকা ছাড়াও তার নিজস্ব সম্পাদনায় পঞ্চাশ দশকে বের হতো ‘অঙ্গনা’ নামের একটি মহিলা মাসিক পত্রিকা। তার প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা একশ’র বেশি।
এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস, গবেষণাধর্মী রচনা, ছোটগল্প, ধর্মীয় কাহিনী, ভ্রমণ কাহিনী, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথা ইত্যাদি। রেডিও, টিভিতে প্রচারিত হয়েছে অসংখ্য নাটক, জীবন্তিকা ও সিরিজ নাটক। তার গল্পে নির্মিত হয়েছে একাধিক চলচ্চিত্র।
রাবেয়া খাতুন উপন্যাস লিখেছেন পঞ্চাশটিরও বেশি, এ যাবৎকাল চার খণ্ডে সংকলিত ছোটগল্প সংখ্যায় চারশ’র বেশি। ছোটদের জন্য লেখা গল্প-উপন্যাসও সংখ্যায় কম নয়। রাবেয়া খাতুন বাংলাদেশের ভ্রমণসাহিত্যের অন্যতম লেখক। কর্মজীবনে অনেক মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন তিনি।
উদ্বুদ্ধ হয়েছেন যাদের দ্বারা স্মৃতিমূলক রচনার মধ্য দিয়ে তাদের ব্যক্তিত্ব ও বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিত্বকে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। ছোটগল্প দিয়ে শুরু হলেও লেখক-পরিচয়ে প্রথমত তিনি ঔপন্যাসিক। প্রথম উপন্যাস মধুমতী (১৯৬৩) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি পান।
ক্ষয়িষ্ণু তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবনসংকট ও নাগরিক উঠতি মধ্যবিত্ত জীবনের অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার মধ্যে ব্যক্তিকে আবিষ্কার করেছিলেন রাবেয়া খাতুন এই উপন্যাসে। রাবেয়া খাতুন ভ্রমণসাহিত্য রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করেছেন বলে তার ভ্রমণসাহিত্যের বইও অনেকগুলো।
বেশকিছু আত্মজৈবনিক স্মৃতিমূলক রচনা লিখেছেন। একাত্তরের নয় মাস (১৯৯০) বইয়ে লিখেছেন একাত্তরের শ্বাসরূদ্ধকর দিনগুলোর কথা।
সাহিত্য চর্চ্চার জন্য পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন একুশে পদক (১৯৯৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৩), নাসিরুদ্দিন স্বর্ণ পদক (১৯৯৫), হুমায়ূন স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৯), কমর মুশতারী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৯৪), শের-ই-বাংলা স্বর্ণ পদক (১৯৯৬), ঋষিজ সাহিত্য পদক (১৯৯৮), লায়লা সামাদ পুরস্কার (১৯৯৯) ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯)।
ছোট গল্পের জন্য পেয়েছেন নাট্যসভা পুরস্কার (১৯৯৮)। সায়েন্স ফিকশন ও কিশোর উপন্যাসের জন্য পরস্কৃত হয়েছেন শাপলা দোয়েল পুরস্কার (১৯৯৬), অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার (১৯৯৮), ইউরো শিশু সাহিত্য পুরস্কার (২০০৩)। ছোটগল্প ও উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে প্রেসিডেন্ট (১৯৬৬), কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি (২০০৩), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪), ধ্রুবতারা, মধুমতি (২০১০) ইত্যাদি।
টিভি নাটকের জন্য পেয়েছেন টেনাশিনাস পুরস্কার (১৯৯৭), বাচসাস (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি) পুরস্কার, বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড (২০০০), টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাওয়ার্ড (২০০০)সহ তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন।