নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চলতি সপ্তাহেই এমপিওভুক্ত করার জন্য নীতিমালা সংশোধনের কাজ শেষ হবে। এরপরই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা চাইবে মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য দ্রুত আবেদন চাওয়া হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। প্রসঙ্গত, দেশজুড়ে একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রায় সাড়ে ছয় হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ২০১০ সালে ষোলোশর কিছু বেশি এবং গত বছর আড়াই হাজারের বেশি নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করে। গত বছর যে নীতিমালায় প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছিল তাতে বহু প্রতিষ্ঠান এমপিও পায়নি। এজন্য নীতিমালা সংশোধনে কমিটি করে সরকার। সেই সংশোধিত নীতিমালাও প্রস্তুত, কেবল শিক্ষামন্ত্রীর সই বাকি।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক অনুবিভাগ) মোমিনুর রশীদ আমিন ভোরের কাগজকে বলেন, নীতিমালা সংশোধনের কাজ শেষ হয়েছে। এখন শিক্ষামন্ত্রী সই করলেই নীতিমালা প্রকাশ করা হবে। এরপরই চলতি অর্থবছরে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি করা হবে কিনা- এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি চাওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিলেই নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির আবেদন চাওয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেছেন, চলতি অর্থবছরে এমপিওভুক্তির নামে কোনো বাজেট নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্য খাতের বাজেট থেকে এনে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিতে হবে।
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মাহমুদন্নবী ডলার ভোরের কাগজকে বলেন, সংশোধনের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য যে নীতিমালা জারি হচ্ছে তাতে হয়তো কিছু স্কুল ও মাদ্রাসা নতুন করে এমপিও পেতে পারে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কলেজ নতুন এমপিও পাবেই না বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এমপিওভুক্তির প্রথম নীতিমালায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কলেজকে এমপিও পেতে হলে গ্রামাঞ্চলে থাকতে হবে ৪০ এবং শহরে ৬০ জন শিক্ষার্থী। তাতে গত বছর ৮২টি কলেজ এমপিওভুক্ত হয়েছিল।
কিন্তু সংশোধিত নীতিমালায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কলেজকে এমপিও পেতে হলে গ্রামাঞ্চলের কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে শিক্ষার্থী থাকতে হবে ১০৫ এবং শহরাঞ্চলের কলেজে শিক্ষার্থী থাকতে হবে ১৩৫ জন। তিনি বলেন, দেশের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সব কলেজে এত শিক্ষার্থী নেই। আর শিক্ষার্থী না থাকায় তারা এমপিও পাবেন না। এজন্য সরকারকে আমরা বলেছিলাম, মানবিক হয়ে স্বীকৃতি পাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্ত করে নেয়ার জন্য। তারপর নীতিমালা জারি করে সবাইকে বলে দেয়া, এখন থেকে আর কোনো প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে না। যদি কোনো জায়গায় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের দরকার হয় তবে তা সরকার করবে। এভাবে গণহারে আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না।
এর আগে গত ৫ অক্টোবর শিক্ষক দিবসের একটি অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা সংশোধন করা হচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নতুন করে এমপিও দিতে গ্রামাঞ্চলের জন্য শর্ত শিথিল করা হবে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মেট্রোপলিটন সিটি, জেলা শহর, উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায়ের আলাদা শর্ত থাকবে। গ্রামাঞ্চল ও চরাঞ্চলসহ পিছিয়ে পড়া এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য শর্ত শিথিল করা হবে। আগে এমপিওভুক্তিতে সবার জন্য একই শর্ত ছিল।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘ ১০ বছর বন্ধ থাকার পর গত বছর ২৩ অক্টোবর একযোগে দুই হাজার ৭৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে তালিকা প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর ওই বছরের ১২ নভেম্বর ছয়টি এবং ১৪ নভেম্বর একটি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়। নতুন এমপিও পাওয়া এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্তীকরণ এখনো চলছে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির চারটি শর্তের প্রতিটির মান ২৫ নম্বর। এই ১০০ নম্বরের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।নীতিমালার ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এমপিও পেতে প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতি থাকার জন্য নম্বর ২৫। একাডেমিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে প্রতি দুই বছরের জন্য ৫ নম্বর এবং ১০ বা এর চেয়ে বেশি বছর হলে পাবে পূর্ণ ২৫ নম্বর।
শিক্ষার্থী সংখ্যার জন্য রয়েছে ২৫ নম্বর। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষার্থী থাকলে ওই প্রতিষ্ঠান পাবে ১৫ নম্বর এবং এর পরবর্তী ১০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য পাবে ৫ নম্বর করে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যায়ও রয়েছে ২৫ নম্বর। কাম্যসংখ্যক পরীক্ষার্থীর জন্য ১৫ নম্বর, কাম্যসংখ্যার পরবর্তী প্রতি ১০ জনের জন্য পাবে ৫ নম্বর করে। পাবলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পরিসংখ্যানেও স্বীকৃত পাওয়ার নম্বর ২৫। এর মধ্যে কাম্যহার অর্জনের ক্ষেত্রে ১৫ নম্বর, পরবর্তী প্রতি ১০ শতাংশের জন্য পাবে ৫ নম্বর। এই নীতি অনুসরণ করে ২০১৯ সালে ২ হাজার ৭৩৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির তালিকা তৈরি হয়। এর মধ্যে দুয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাদ পড়েছে বিভিন্ন সমস্যার কারণে।
সংশোধিত নীতিমালায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন এলাকায় বিভক্ত করা হয়েছে। যথাক্রমে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও মফস্বল এলাকা। নি¤œ মাধ্যমিক স্তরের (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম) প্রতিটি শ্রেণিতে ৪০ জন করে শিক্ষার্থী থাকতে হবে। একটি শ্রেণিতে ৮০ জন শিক্ষার্থী হলে নতুন শাখা খুলতে পারবে। মাধ্যমিক স্তরে প্রতি শ্রেণিতে ৪০ জন করে শিক্ষার্থী থাকতে হবে। সিটি করপোরেশন এলাকার উচ্চমাধ্যমিক স্তরে তথা একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে মানবিক ও ব্যবসায়শিক্ষার প্রতি বিভাগে ৫০ জন করে মোট ১০০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। একই স্তরের মফস্বল এলাকায় প্রতি শ্রেণিতে ৪০ জন করে মোট ৮০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। পাবলিক পরীক্ষায় ৩৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নিতে হবে। মফস্বল এলাকার বিজ্ঞান বিভাগে প্রতি শ্রেণিতে ৩০ জন করে শিক্ষার্থী থাকতে হবে। সিটি করপোরেশন এলাকায় নি¤œ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশ, পৌর এলাকায় ৬০ ও মফস্বল এলাকার প্রতিষ্ঠানে ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করতে হবে। সিটি করপোরেশন এলাকায় উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের ৬৫ শতাংশ, পৌর এলাকায় ৬০ ও মফস্বল এলাকার প্রতিষ্ঠানে ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করতে হবে। আর ডিগ্রি স্তরে সিটি করপোরেশন এলাকায় ৫৫ শতাংশ, পৌর এলাকায় ৫০ শতাংশ ও মফস্বল এলাকায় ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করতে হবে। ভাড়া বাসাবাড়িতে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে না।
বর্তমানে দেশে একাডেমিক স্বীকৃতি পাওয়া নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ৫ হাজার ২৪২টি। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে নতুন এমপিও পেয়েছে ২ হাজার ৭৩৭টি। এছাড়া একাডেমিক স্বীকৃতির বাইরে রয়েছে আর ২ হাজারেরও বেশি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বেসরকারি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে এক লাখের বেশি।