বড় বিনিয়োগ ও ব্যবসার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে টাওয়ার কোম্পানি

বাংলাদেশ

দ্রুত নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও মানসম্পন্ন সেলফোন সেবা নিশ্চিতে ২০১৮ সালে চারটি প্রতিষ্ঠানকে টেলিযোগাযোগ টাওয়ার ব্যবস্থাপনার লাইসেন্স দেয় সরকার। তবে চুক্তিসহ অন্যান্য জটিলতায় লাইসেন্স দেয়ার দুই বছরেও স্থবির হয়ে ছিল খাতটি। সম্প্রতি এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে টাওয়ার কোম্পানিগুলো।এরই মধ্যে সেলফোন অপারেটরদের সঙ্গে টাওয়ার স্থাপনে চুক্তিও হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাটাভিত্তিক সেবার ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী সাত বছরে এ খাতে ১৫ হাজারের বেশি টাওয়ার নির্মাণের প্রয়োজন হবে। আর টাওয়ার কোম্পানিগুলোর বড় হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেবে এ চাহিদা।

টাওয়ার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তৃতীয় পক্ষের প্রতিষ্ঠানের কাছে দেয়ার বিধান রেখে ২০১৮ সালের নভেম্বরে চার প্রতিষ্ঠানের কাছে লাইসেন্স হস্তান্তর করা হয়।প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ইডটকো বাংলাদেশ কো. লিমিটেড, সামিট টাওয়ারস লিমিটেড, কীর্তনখোলা টাওয়ার বাংলাদেশ ও এবি হাইটেক কনসোর্টিয়াম লিমিটেড। এর মধ্যে কমিশনের কাছ থেকে নেয়া অনাপত্তিপত্রের মাধ্যমে ২০১৩ সাল থেকে কার্যক্রম চালু রয়েছে ইডটকোর।

লাইসেন্স নেয়ার সময় কোম্পানিগুলোর দেয়া তথ্যানুযায়ী, ইডটকো বাংলাদেশের দেশীয় বিনিয়োগকারী গ্রিনকন টাওয়ার কোম্পানি ও বিদেশী অংশীদার আজিয়াটার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইডটকো গ্রুপ। কীর্তনখোলা টাওয়ারে কনফিডেন্স টাওয়ার হোল্ডিংস দেশীয় বিনিয়োগকারী ও আইএসওএন ইসিপি টাওয়ার সিঙ্গাপুর বিদেশী বিনিয়োগকারী হিসেবে রয়েছে। এবি হাইটেক কনসোর্টিয়াম লিমিটেডে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারী রয়েছে মোট নয় প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে দেশীয় বিনিয়োগকারী এডিএন টেলিকম, এবি হাইটেক ইন্টারন্যাশনাল, জেডএন এন্টারপ্রাইজ, মিম জিম টেলিকমিউনিকেশন, সাদিয়া এন্টারপ্রাইজ, সিনার্জি লজিস্টিক ও অরেঞ্জ ডিজিটাল। আর বিদেশী বিনিয়োগকারী চায়না কমিউনিকেশনস সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল ও চ্যাংসু ফেংফান পাওয়ার ইকুইপমেন্ট কো. লিমিটেড সামিট কমিউনিকেশনস সামিট টাওয়ারস লিমিটেডের দেশীয় বিনিয়োগকারী। প্রতিষ্ঠানটিতে বিদেশী বিনিয়োগকারী হিসেবে রয়েছে টিএএসসি টাওয়ারস ও গ্লোবাল হোল্ডিং করপোরেশন।

সামিট টাওয়ারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ আল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, এ খাতে আগামী দিনে বড় সম্ভাবনা রয়েছে। ডাটার চাহিদা বাড়ছে। ফোরজি সেবার সম্প্রসারণে আরো টাওয়ারের প্রয়োজন হবে। সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি আমরা। এরই মধ্যে একশ টাওয়ার স্থাপন সম্পন্ন করেছে সামিট।

নেটওয়ার্ক অবকাঠামো ব্যবস্থাপনায় বিপুল ব্যয়ের পাশাপাশি অনেক জনবলেরও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ভূমি ও বিদ্যুতের সংকট ছাড়াও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে টাওয়ারের অনিয়ন্ত্রিত সংখ্যা বৃদ্ধি। এসব কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টাওয়ার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থেকে নিজেদের সরিয়ে আনছে অপারেটররা এক্ষেত্রে অবকাঠামো ভাড়া প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সেবা নেয় তারা। ফলে একই অবকাঠামো ভাগাভাগির মাধ্যমে তা থেকে সেবা পেতে পারে একাধিক অপারেটর।

গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তির সেবা চালুর প্রয়োজনে টাওয়ার ও বিটিএসের সংখ্যা বাড়িয়েছে সেলফোন অপারেটররা টুজি, থ্রিজির পর দেশে গত বছর ফোরজি প্রযুক্তির সেবা চালু হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্যমতে, চলতি বছরের নভেম্বর শেষে সেলফোন অপারেটরদের সংযোগসংখ্যা ১৬ কোটি ৮৩ লাখ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের ৭ কোটি ৮১ লাখ, রবি আজিয়াটার ৫ কোটি ৫ লাখ, বাংলালিংকের সাড়ে ৩ কোটি ও টেলিটকের ৪৬ লাখ ৩১ হাজার সংযোগ রয়েছে।

খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে টাওয়ারের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৩৫ হাজার। প্রযুক্তিভেদে টাওয়ারগুলোতে বিটিএস, নোডবি ও ই-নোডবি স্থাপন করেছে অপারেটররা। প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর সংখ্যাও বাড়ছে। বিটিআরসির হিসাবে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে দেশে বিটিএসের সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৯টি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ সংখ্যা পৌঁছে ৮৪ হাজার ৫২৭টিতে।

টেলিযোগাযোগ টাওয়ার-সংক্রান্ত বৈশ্বিক প্লাটফর্ম টাওয়ার এক্সচেঞ্জের তথ্য বলছে, দেশে সবচেয়ে বেশি রয়েছে গ্রামীণফোনের। অপারেটরটির টাওয়ারের সংখ্যা ১২ হাজার। এছাড়া ইডটকোর ৯ হাজার ৬৩৭টি, বাংলালিংকের ৭ হাজার, টেলিটকের সাড়ে তিন হাজার ও রবির ১ হাজার ৯৭টি টাওয়ার রয়েছে। এর বাইরে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিটিসেলসহ অন্যদের আরো ৫০০-এর মতো টেলিযোগাযোগ টাওয়ার রয়েছে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বণিক বার্তাকে বলেন, টেলিযোগাযোগ সেবার মানোন্নয়নে টাওয়ারসহ অবকাঠামোর বড় ভূমিকা রয়েছে। টাওয়ার ব্যবস্থাপনায় লাইসেন্স চালুর অন্যতম উদ্দেশ্য সেবার মান নিশ্চিত করা। পাশাপাশি সেলফোন অপারেটরদের জন্য এটি ইতিবাচক। নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে টাওয়ার কোম্পানির কাছ থেকে নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী সেবা নিতে পারবে তারা। লাইসেন্স পাওয়া কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে। আগামী দিনে এ বিনিয়োগ আরো বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সার্ভিস লেভেল এগ্রিমেন্ট (এসএলএ) নিয়ে গত দুই বছরে একমত হতে পারেনি সেলফোন অপারেটর ও টাওয়ার কোম্পানি।এজন্য টাওয়ার শেয়ারিং সেবার লাইসেন্স পাওয়া তিনটি প্রতিষ্ঠানের সেবাদান কার্যক্রম বিলম্বিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যস্থতায় বিষয়টির সমাধান করা হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৬ নভেম্বর বাংলালিংকের সঙ্গে চুক্তি করে সামিট কমিউনিকেশনস। চুক্তির আওতায় সামিট বাংলালিংকের জন্য ২৫৯টি টাওয়ার নির্মাণ করবে।কীর্তনখোলা টাওয়ার বাংলাদেশের ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিসেস জানিয়েছে, বিভিন্ন অপারেটরের সঙ্গে বাণিজ্যিক আলোচনা চলছে। শিগগিরই টাওয়ার নির্মাণ শুরু করবে প্রতিষ্ঠানটি।

টাওয়ার ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সেবা নিতে পারবে সেলফোন অপারেটররা।আর টাওয়ার ব্যবস্থাপনা লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে সেলফোন অপারেটরদের কাছ থেকে টাওয়ার কিনে বা ভাড়ার ভিত্তিতে ব্যবহার করতে পারবে প্রতিষ্ঠানগুলো, যা অন্য সেলফোন অপারেটরদের ভাড়া দেবে তারা। টাওয়ার ব্যবস্থাপনার লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক অবকাঠামো সম্প্রসারণের পাশাপাশি সেলফোন অপারেটরদের নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির ভিত্তিতে টাওয়ার ব্যবহারের কার্যক্রম কমিয়ে আনতে হবে।

এবি হাইটেক কনসোর্টিয়ামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মঞ্জুরুল হাসান বলেন, তিন মাসে তিনশ টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। রবির সঙ্গে ১০০ টাওয়ার নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ করেছে এবি হাইটেক।

২০১৮ সালের এপ্রিলে টাওয়ার শেয়ারিং নীতিমালা প্রকাশ করে বিটিআরসি। নীতিমালা অনুযায়ী, টাওয়ার শেয়ারিং লাইসেন্সের মেয়াদ ১৫ বছর। লাইসেন্স পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে কার্যক্রম শুরুর বাধ্যবাধকতা দেয়া হয় এতে। কোম্পানিগুলো দ্বিতীয় বছর থেকে বার্ষিক লাইসেন্স ফি ও আয়ের ভাগাভাগির অংশ সরকারকে দেবে। বার্ষিক ৫ কোটি টাকা লাইসেন্স ফি ধরা হয়েছে তাদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *