অবশেষে বৃটেন সীমান্ত নিয়ে ফ্রান্স সরকারের সাথে একটি সমঝোতা হয়েছে। বৃটেনে করোনা ভাইরাসের নতুন রূপ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে ফ্রান্স ৪৮ ঘণ্টার জন্য রোববার থেকে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। পরিবহণ সচিব মি. শ্যাপস টুইট করে বলেছেন, আজ ভাল অগ্রগতি এবং সীমান্তে ফরাসী সরকারের সাথে সমঝোতা হয়েছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে যানবাহন চালকদের জন্য করোনা পরীক্ষা ব্যবহারের প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন বলে জানা গেছে। সরকারী সূত্রগুলি জানিয়েছে, সীমান্ত পুনরায় খোলার ব্যবস্থা নিয়ে উভয় পক্ষ মোটামুটি সমঝোতায় পৌঁছেছেন। তবে আজ কখন থেকে কার্যকর হবে তা এখনো জানা যায়নি। বরিস জনসন সেনা বাহিনী পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সেনা সদস্যরা লরি ও ট্রাক চালকদের করোনা টেস্ট পরিচালনা করবেন।
ফরাসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, আজ বুধবার থেকে যানবাহন চলাচল আবার শুরু হবে। বিমান, নৌযান ও ইউরোস্টার ট্রেনগুলি আবার পরিষেবা শুরু করবে।করোনা পরীক্ষায় নেতিবাচক ফলাফল হলে ইইউ এবং ফরাসী বাসিন্দা ও নাগরিকরা দেশে ফিরতে পারবেন। এছাড়াও করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) বিরুদ্ধে লড়াই করা স্বাস্থ্যকর্মী, বিশেষ প্রয়োজনের যাত্রী, আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহণ সরবরাহকারী, ফিশিং ক্রু এবং বাস বা ট্রেন চালকরাও এই নিয়মের আওতায় পড়বেন।
ফরাসী পরিবহনমন্ত্রী জ্যান ব্যাপটিস্ট দেজেবারি বলেছেন, ভ্রমণের জন্য প্রস্থানের ৭২ ঘণ্টারও কম সময়ের করোনা টেস্টের নেগেটিভ রিজাল্ট থাকতে হবে। এটি হতে হবে সময়সাপেক্ষ পিসিআর পরীক্ষা বা দ্রুততর পার্শ্ব-প্রবাহ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা, যা দিয়ে করোনার নতুন রূপটি শনাক্ত করা যায়।
সুত্রমতে, পিসিআর (পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন) কোভিড পরীক্ষাটি এপিডেমিওলজিস্টরা ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ হিসেবে বিবেচনা করার পর ফলাফল পেতে আরও এক দিন বা বেশি সময় লাগবে। কারণ নমুনাটি পরীক্ষাগারে পাঠাতে হবে।
এদিকে রোববার ফ্রান্স কর্তৃক সীমান্ত বন্ধ ঘোষণার পর ইংলিশ চ্যানেলের তীরবর্তী ফেরি ও টানেল দিয়ে পার হওয়া সকল গাড়ি ও লরি ফ্রান্সে ঢোকা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মালামাল পরিবহনের অসংখ্য গাড়ির দীর্ঘলাইন ধরেছে। এম-২০ মোটরওয়েতে প্রায় ১৮ মাইল প্রসারিত সড়কে অসংখ্য লরি আটকে আছে। মেইডস্টোন এবং অ্যাসফোর্ডের মধ্যবর্তী এলাকা বন্ধ হয়ে আছে। নতুন আগতদের ম্যানস্টন বিমানবন্দরে প্রেরণ করা হচ্ছে। যেখানে ৪ হাজার লরির জন্য জায়গা রয়েছে। অন্যদিকে প্রায় ২০০ ট্রাক অ্যাসফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল ট্রাকস্টপে জমায়েত হয়েছে। চালকরা তাদের যানবাহনগুলিতে দ্বিতীয় রাতও নিদ্রাহীন কাটিয়েছেন। কেন্ট কাউন্টি কাউন্সিলের নেতা রজার গফ বলেছেন, ম্যানস্টনের অস্থায়ী লরি পার্কে ২ হাজারি, ২২০টি গাড়ি এবং এম-২০ তে ৬৩২ টি গাড়ি রাখা হয়েছে।
কেন্ট কাউন্সিল জানিয়েছে, সীমান্ত বন্ধের কারণে যুক্তরাজ্য ছাড়ার অপেক্ষায় ২ হাজার ৮৫০টিরও বেশি লরি আটকে আছে। এখনো পোর্ট অফ ডোভার বা ইউরোটানেল খুলছে না। ফলে কোনও যানবাহন ছাড়েনি।
‘আমরা ক্লান্ত, আমরা হতাশ, আমরা ভীত’। যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের সীমান্তবর্তী কেন্ট ও আশেপাশে আটকে থাকা প্রায় ৩ হাজার মালবাহী লরি ড্রাইভারদের আর্তনাদ এটি। বাণিজ্য ও যাতায়াতের জন্য পুনরায় সীমান্ত না খোলা পর্যন্ত রাত-দিন অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তারা। বন্দর বিশৃঙ্খলার মাঝে ক্লান্ত-শ্রান্ত ট্রাক ও লরি চালকদের অসহনীয় ও দুঃসহ দিনাতিপাত এক করুণ অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
এদিকে ইইউ কমিশন ইউরোপীয় দেশগুলিকে তাদের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার তুলে দেয়ার অনুরোধ করেছে। সমস্ত সদস্য দেশকে সুপারিশে বলা হয়েছে, সরবরাহ চেইনের ব্যত্যয় এড়াতে ফ্লাইট ও ট্রেন সচল করা উচিত। এতে বলা হয়, লোকেরা তাদের ভ্রমণ করার অনুমতি পাবে, তবে তারা কোভিড -১৯ পরীক্ষা নেবে বা স্ব-বিচ্ছিন্ন (আইসোলেশন) হয়ে যাবে। তবে কমিশন বলেছে, অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণকে নিরুৎসাহিত করা উচিত।
সীমান্ত বন্ধের ফলে বৃটিশ ব্যবসার সুদূরপ্রসারী পরিণতি ঘটতে পারে। স্কটিশ ফিশিং সংস্থাগুলি সালমন মাছ দিয়ে ভরা ১০০ টিরও বেশি লরি আটকে থাকায় ৬ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি ক্ষতির আশংকা করছেন। স্কটিশ সীফুড অ্যাসোসিয়েশনের চিফ এক্সিকিউটিভ জিমি বুচান মিডিয়াকে বলছিলেন, তাদের শিল্পটি একটি ‘বিপর্যয়ের’ মুখোমুখি হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ তিনি দেখাচ্ছিলেন, সীমান্তে একটি অপেক্ষাকৃত ছোট সংস্থার ২লাখ ৩০ হাজার পাউন্ডের লাইভ শেলফিশ আটকে রয়েছে। আরও ২লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডের মালামাল প্রস্তুতি রয়েছে । আরেকটি বড় পোশাকের ৫ লাখ পাউন্ডের মালামাল আটকে আছে এবং তাদের সাড়ে ৭ লাখ পাউন্ডের ডেলিভারি প্রস্তুতি রয়েছে। যার সবগুলিই ক্রিসমাসের বাজারের জন্য প্রস্তুত।
এদিকে কেন্ট কাউন্টি কাউন্সিল এবং দাতব্য সংস্থাসমূহ আটকে থাকা গাড়ির চালকদের পানি এবং স্ন্যাকস সরবরাহ করছেন। তবে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, তিনি এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সীমান্ত অবরোধ মুক্ত করার জন্য কাজ করছেন।
নতুন বৈশিষ্ট্যের করোনা ভাইরাস দ্রুত সংক্রমণকে কেন্দ্র করে গত রোববার লন্ডন এবং সাউথ ইস্ট ইংল্যান্ডে টিয়ার-৪ বা সর্বোচ্চ মাত্রার লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে মন্তব্য করেছেন। এমন ঘোষণার পর থেকেই দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বিশ্বজুড়ে। বিভিন্ন দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে শুরু করে। ইতিমধ্যে এশিয়া ও ইউরোপ সহ বিভিন্ন দেশের সাথে বৃটেনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
প্রথম ফ্লাইট বাতিলের ঘোষণা দেয় নেদারল্যান্ডস। এর পরেই সড়ক, সমুদ্র , রেল ও আকাশ পথে মালামাল বহনকারী লোকজনও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েন। রোববার থেকেই একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আসতে শুরু করে। এরমধ্যে যুক্ত হয় আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, পর্তুগাল, সুইডেন, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, পোল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া ও তুরস্ক। ইউরোপের বাইরের দেশ কানাডা, ইরান, সৌদি আরব, ইসরাইল, কুয়েত এল সালভাদর, আর্জেন্টিনা, চিলি, মরক্কো, স্পেন, ভারত, পাকিস্তান, হংকং, কানাডা, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি।
এ অবস্থায় করণীয় নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন বরিস জনসন। বিশেষ করে এ সময়টাতে খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলায় মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন তিনি। সরকারের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি বড়দিনে খাদ্য সংকট এড়াতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সুপার মার্কেট স্যান্সবারি বলেছে, ফ্রেঞ্চ-ইউকে সীমান্ত বন্ধের ফলে অনেক আইটেম সংকট হতে পারে। এবিষয়ে খুচরা বিক্রেতাদের মতে, তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। টেসকো বলেছে, টয়লেট রোলস, ডিম, চাল এবং হাত ধোয়ার মতো কিছু প্রয়োজনীয় পণ্যগুলির উপর অস্থায়ী ক্রয়ের সীমা পুনঃর্নির্মাণ করবে। এই খবর প্রকাশের সাথে সাথে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের জন্য মানুষ বড় বড় মার্কেটে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন।
এদিকে সুইজারল্যান্ডের বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুবিজ্ঞানী ও মিউটেশন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিচার্ড নেহার বলেছেস, বৃটেনে রূপান্তরিত করোনাভাইরাসটি কয়েক মাস ধরেই সক্রিয় ছিল। ভাইরাস নিয়ে নিবিড় ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের সময় গত ২০ সেপ্টেম্বর এটি আবিষ্কৃত হয়। গত কয়েক সপ্তাহে এটি বৃটেনের বেশ কয়েকটি অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। বৃটেনের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা বলেছেন, নতুন রূপের ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও ব্যাপক এলাকা জুড়ে বিধিনিষেধ আরোপের সম্ভাবনা রয়েছে।
জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েন্স স্পান বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বৃটেনে শনাক্ত নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ফাইজার-বায়োএনটেকের বিদ্যমান টিকা কার্যকর। বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে ইতিমধ্যে এই টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সির (ইএমএ) বিজ্ঞানীরাও বলেছেন, খুব সম্ভবত ইংল্যান্ডে সনাক্ত হওয়া নতুন রূপের করোনার বিরুদ্ধে ফাইজার–বায়োএনটেকের টিকা সুরক্ষা বজায় রাখবে।