বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংক

বাংলাদেশ

চলতি বছরের ব্যাংকের হিসাব চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সব অশ্রণেীকৃত ঋণ বা বিনিয়োগের বিপরীতে অতিরিক্ত এক শতাংশ জেনারেল প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা পরিপালন করতে গিয়ে বেশির ভাগ ব্যাংকই এখন হিমশিম খাচ্ছে বলে ব্যাংকারেরা জানিয়েছেন। এমনিতেই ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয়ায় এবং এক বছর ঋণশ্রেণীকরণের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়ায় ব্যাংকের আয় কমে গেছে। এর ওপর বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকের নিট আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে তারা জানিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকাররা এ নির্দেশনা আরো সুনির্দিষ্ট করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রভাব সবশ্রেণীর ব্যবসার ওপরই পড়েছে। বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ভোগব্যয় কমে যাওয়ায় শিল্পের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ঋণনির্ভর উদ্যোক্তারা ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করেন। এক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ শ্রেণীকরণের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়া হয়। প্রথমে, জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত, পরে আরো দুই দফা বাড়িয়ে তা ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। অর্থাৎ পুরো এক বছর কেউ ঋণ পরিশোধ না করলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীকে ঋণ খেলাপি করা যাবে না। এতে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে পারতেন তারাও এক পর্যায়ে ঋণ পরিশোধ বন্ধ করে দেন।
অপর দিকে গত ১ এপ্রিল থেকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা পরিপালন করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর রাতারাতি আয়ের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। এমনি পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গত ১০ ডিসেম্বর এক সার্কুলার জারি করে। অনাদায়ী ঋণের সুদ ব্যাংকগুলোর যাতে আয় খাতে নিতে না পারে সেজন্য বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। বলা হয়, ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ থেকে অর্জিত সুদ আয় খাতে নিতে হলে ঋণের পরিমাণ ভেদে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ থেকে শাখা ব্যবস্থাপককে সুপারিশ করতে হবে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর জন্য ভালো ছিল। কারণ, ঋণ আদায় না হলে ওই ঋণ খেলাপি হতো। আর খেলাপি ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে নিতে পারে না। কারণ ব্যাংকগুলোর যে পরিমাণ আয় হয় তার প্রায় ৪০ শতাংশই সরকারকে কর দিতে হয়। এর পরে যেটুকু থাকে তা বিভিন্ন নির্দেশনা অনুযায়ী সংরক্ষণ করার পর বাকি অর্থ থেকে ডিভিডেন্ড ঘোষণা করা হয়। এখন ঋণ আদায় না হলেও ওই ঋণকে নিয়মিত দেখিয়ে কেউ আয় খাতে নিলে এটা প্রকৃত আয় না হয়ে হবে কাগুজে আয় বা কৃত্রিম আয়। এ কৃত্রিম আয় থেকে অর্থ সরকারের ট্যাক্স এবং বিনিয়োগকারীকে ডিভিডেন্ড আকারে বিতরণ করা হলে ব্যাংকের মূলভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। এ কারণে ব্যাংকাররা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা ভালোভাবেই গ্রহণ করেছে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিয়েছে বাড়তি জেনারেল প্রভিশন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে। একই সার্কুলারে আরেক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো আগামী ৩১ ডিসেম্বরভিত্তিক ব্যাংকের হিসাব চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে অনাদায়ী ঋণ (এসএমএ) বা বিনিয়োগসহ সব অশ্রেণীকৃত বিনিয়োগের বিপরীতে ১ শতাংশ অতিরিক্ত জেনারেল প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। এমন নির্দেশনাই পরিপালন করতে ব্যাংকারদের বিপত্তি বেধেছে।

গতকাল দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, করোনার মধ্যেও অনেক ভালো গ্রাহক কষ্ট করে ঋণ পরিশোধ করেছেন। আবার এসএমই, কৃষি, ভোক্তাঋণসহ অনেক ঋণই বেশির ভাগই আদায় হয়েছে। এখন সব ঋণের ওপর বাড়তি এক শতাংশ প্রভিশন রাখলে ব্যাংকের প্রকৃত আয় অনেক কমে যাবে। কারণ, একটি ব্যাংকের ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ বা ঋণ থাকলে এর বিপরীতে ১ শতাংশ বাড়তি প্রভিশন রাখতে হলে হবে ২০০ কোটি টাকা।

এমনিতেই ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনায় ব্যাংকগুলোর আয় কমে গেছে, এর ওপর বাড়তি ২০০ কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হলে প্রকৃত আয় আরো কমে যাবে। এজন্য তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আরো স্পষ্ট করার অনুরোধ করেছেন। অপর একজন তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, করোনার সময়ে যেসব ঋণের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে বা ঋণ আদায় হয়নি শুধু ওইটুকু ঋণের ওপর বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণে তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু ভালো ঋণের ওপরও বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হলে তাদের আয়ের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। বিষয়টি ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা বিবেচনা করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

প্রসঙ্গ, জেনারেল প্রভিশন হলো, আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষা করতে সংরক্ষিত অর্থ। ঋণের ধরন ভেদে ১ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত এ জেনারেল প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। এ কারণেই যত বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়, ব্যাংকের ভিত্তি তত মজবুত হয়, তবে ব্যাংকের আয়ও কমে যায়। এ কারণেই ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অনেক সময় গড়িমসি করতে দেখা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *