জেল থেকে বের হয়েই ভোল পাল্টে ফেললেন সেই কারা ডিআইজি বজলুর রশীদ। যিনি দুর্নীতির টাকা জায়েজ করতে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা পাঠিয়েছেন।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানেও যার বিরুদ্ধে ৩ কোটি ৮ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মিলেছে। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ডিআইজি ১ নভেম্বর জামিনে জেল থেকে ছাড়া পেয়েই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে মরিয়া হয়ে মঠে নেমেছেন। এমনকি তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) মামলাকে তিনি অসত্য, কাল্পনিক, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বলে দাবি করেছেন।
এদিকে সূত্র জানায়, প্রকৃত তথ্য গোপন করে তিনি জামিন নিয়েছেন। এ কারণে দুদক জামিন বাতিলের জন্য ইতোমধ্যে আপিল করেছে।
প্রসঙ্গত, ‘বেপরোয়া ডিআইজি প্রিজনের ঘুষ-কাণ্ড: স্ত্রী কুরিয়ার সার্ভিসে নেন কোটি কোটি টাকা’ শিরোনামে গত বছরের ৬ অক্টোবর যুগান্তরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়।
ঘুষের টাকা লেনদেন করতে বজলুর রশীদ নিজের ঠিকানা গোপন করে স্ত্রীর নামে মোবাইল ফোনের সিম কেনেন। সরাসরি টাকা না পাঠিয়ে ঘুষ চ্যানেলের মাধ্যমে তিনি টাকা আদানপ্রদান করতেন। নিরাপদ ভেবে এসএ পরিবহনের কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ২৪টি রসিদে প্রায় কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে।
ওইদিনই প্রতিবেদনটি আমলে নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের চৌকস কর্মকর্তা পরিচালক মো. ইউসূফ হোসেনের নেতৃত্বে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত টিমও গঠন করা হয়। টানা ১৪ দিনেই এই টিম তদন্ত করে বজলুর রশীদের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র হাতে পায়। এরপর ওই বছরের ২০ অক্টোবর বজলুর রশীদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকে হাজির হতে বলা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে কোটি কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে তিনি সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে পারেননি। ওইদিনই দুদকের উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন বাদী হয়ে মামলা করেন বজলুর রশীদের বিরুদ্ধে এবং মামলা দায়েরের পর তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। পরে তাকে সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জানা যায়, প্রাথমিক অনুসন্ধানেই দুদক ৩ কোটি ৮ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়ে যায়। বেইলী রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে রূপায়ণ হাউজিং নির্মিত স্বপ্ন নিলয়ে আলিশান অ্যাপার্টমেন্টে ২ হাজার ৯৮১ বর্গফুট আয়তনের একটি ফ্ল্যাট কেনেন বজলুর রশীদ। এর দাম হিসেবে পরিশোধ করা ৩ কোটি ৮ লাখ টাকার কোনো বৈধ উৎস তিনি প্রদর্শন করতে পারেননি।
এমনকি অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় সংক্রান্ত কোনো তথ্যও তার আয়কর নথিতে প্রদর্শন করেননি। ফলে তার পরিশোধিত এ ৩ কোটি ৮ লাখ টাকা জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। ২৬ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. নাসির উদ্দীন ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে বজলুর রশীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন।
তার বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে ৩ কোটি ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯০২ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয় অভিযোগপত্রে। ১৯৯৩ সালে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়া বজলুর রশীদ ঢাকায় কারা সদর দফতরে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ডিআইজি হিসেবে এর আগে সর্বশেষ ছিলেন রাজশাহীতে।
৩ নভেম্বর কারা মহাপরিদর্শকের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সচিব বরাবর পাঠানো আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, ‘জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ যে সম্পদের কথা বলা হয়েছে তা আমাকে গ্রেফতারের ২ মাস পর দুদক কর্তৃক জব্দ দেখানো হয়েছে, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, বানোয়াট। এমনকি দুদক নিজ সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শুধুমাত্র মামলা রুজুর অনুমোদন চাইলেও গ্রেফতারের কোনো অনুমোদন ছিল না।
এমন এক অসত্য, কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন বিষয়ে অবৈধভাবে আটক থাকার কারণে আমাকে সরকারি চাকুরি আইন ২০১৮ এর ৩৯ (২) ধারা অনুযায়ী সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে, যা আমার দাফতরিক বা চাকরি সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় নয়।’ এই ধারায় কর্মস্থলে যোগদানের বিষয়ে সুবিধা পেতে যুক্তিও খণ্ডন করেন বজলুর রশীদ।
এ বিষয়ে বলা হয়, ‘এই ধারা অনুযায়ী কোনো কর্মচারী দেনার দায়ে কারাগারে আটক থাকলে অথবা কোনো ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার হলে বা তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গৃহীত হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ আটক, গ্রেফতার বা অভিযোগপত্র গ্রহণের দিন থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারবে।’ এ বিষয়ে, ‘বজলুর রশীদ উল্লেখ করেন, অর্থাৎ এটা কর্তৃপক্ষের ঐচ্ছিক ক্ষমতা, যা আইন অনুযায়ী পালন করতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য ছিল না বা নয়।’
আবেদনে সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গও টেনে আনা হয়। বলা হয়, ‘এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ এ প্রসঙ্গটি টেনে তিনি বলেছেন, তিনি অন ডিউটিতে থাকা সত্ত্বেও তাকে গ্রেফতারের অনেক আগেই দুদক কর্তৃক তার ইউনিফর্ম ক্যাপ, বেল্টসহ ইউনিফর্মের কিছু অংশ তাকে নিয়ন্ত্রণকারী ও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে বেআইনিভাবে খুলে নেয়।
আবেদনের শেষ অংশে তিনি এই ঘটনার জন্য দোষারোপ করেন সহকর্মীদের। এ বিষয়ে বলা হয়, ‘শতাধিক অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তে আমার সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তি পেয়েছে এবং শাস্তির অপেক্ষায় আছে। আমার দুর্নীতিবিরোধী দৃঢ় পদক্ষেপে ভীত হয়ে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত কয়েকজন কর্মকর্ত/কর্মচারী/ ব্যক্তি এক জোট হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র করেছে। আমি তাদের ষড়যন্ত্রের শিকার।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের একজন পদস্থ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, নিজের কৃতকর্ম স্বীকার করে সংশোধন হতে পারলেই তিনি প্রকৃত মানুষ। এখন নিজের অপরাধ অন্যের ঘাড়ে দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করা মানেই আরেকটা অপরাধ সৃষ্টি করা। তিনি বলেন, বজলুর রশীদ জামিন নিয়েছেন প্রকৃত তথ্য গোপন করে। আমরা তার জামিনের বিপক্ষে আপিল করেছি।
এ ছাড়া তিনি কর্মস্থলে যোগদান করতে যেভাবে বক্তব্য লিখেছেন তাতে মনে হয়েছে আলাদীনের চেরাগ হাতে পেয়ে দুদক রাতারাতি টাকা খরচ করে আলিশান ফ্ল্যাট তৈরি করে তাকে ফাঁসিয়েছে? তিনি মনে করেন, তার মতো ব্যক্তিদের চাকরিতে রাখা হলে ডিপার্টমেন্টের অনেক বড় ক্ষতি হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, দুদক কর্মকর্তারা পোশাক খুলবে কেন? তিনি ইউনিফর্ম পরে দুদক কার্যালয়ে আসেন। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বিব্রতবোধ করেন।
একপর্যায়ে তাকে পোশাক পরিবর্তন করে আসতে বলা হয়। কিন্তু তিনি বাসায় না গিয়ে দুদকে বসেই অন্য আরেকজনের মাধ্যমে শার্ট, প্যান্টসহ যাবতীয় কাপড় নিয়ে আসেন। নিজের ইচ্ছাতেই ড্রেস পরিবর্তন করেন। মামলায় তার বিনিয়োগ বা লেনদেনের বাইরে কোনো তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি।